header banner

উপলব্ধিঃ জীবন ও জীবিকা- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

উপলব্ধি 
(জীবন এবং জীবিকা)

একটা বিষয় আমি চিরকাল মেনে চলতে চেষ্টা করেছি। জীবন আর জীবিকা এক জিনিস নয়। আমার সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদেরও বোঝাবার চেষ্টা করেছি বিষয়টা। জীবিকার সাথে জীবনকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। কোন ব্যক্তি খুব উঁচু পোস্টে চাকরি করে অথচ অনাথ, দুঃখী, আর্তজনের জন্য মন কাঁদে না তার। তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ এলে সযত্নে এড়িয়ে যায়। এমন ব্যক্তি জীবিকাতে বড় হতে পারে কিন্তু জীবনে বড় নয় বলেই জেনে এসেছি। আবার এমন মানুষও দেখেছি যে চাকরি করে খুবই নগন্য পোস্টে অথচ জীবের মাঝেই শিবকে খুঁজে নেয়। অসহায় অবস্থায় বা দুঃখের দিনে তাকেই পাশে পাওয়া যায়। কে বেশি কাম্য সমাজের কাছে? কে ভাল মানুষ বলে পরিগনিত হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কোন পুরস্কারের কথা বলার দরকার নেই। আবার আছেও। আছে এই কারণে যে, একটু একটু করে ক্ষয় হতে হতে আমাদের মূল্যবোধ তলানিতে ঠেকেছে এখন। জীবিকাসর্বস্ব মানুষকে এখন জাতীয় সঙ্গীত বাজার আগে মনে করিয়ে দিতে হয়, "জাতীয় সঙ্গীতের সময় দয়া করে উঠে দাঁড়াবেন।" চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় অনেককিছুই। লোক দেখানো চটকদারিতে অভ্যস্ত চোখ আমাদের অনেক কিছু সহ্য করে নেয়। তবুও আমরা আশা রাখি। খেলা, বিনোদন, চাকরি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই আমরা আশা করি প্রতিটা ক্ষেত্রই স্বতন্ত্র এবং প্রতি ক্ষেত্রে যুক্ত ব্যক্তি নিজের কাজটি সুচারুভাবে এবং সৎভাবে করবে। অথচ বাস্তবে একটা ক্ষেত্র আর একটার ওপর খবরদারি করে বা মিলে মিশে যায়। যখন খেলায় গেম ফিক্স করা, বিনোদনে নেগেটিভ পাবলিসিটি, রাজনীতিতে নীতিহীনতা বা চাকরিতে উৎকোচ নেওয়ার কথা শুনি তখন আমাদের আশাহত হতে হয়। এইসব ব্যক্তিদের কাছে জীবিকা আর জীবন কি আলাদা কিছু? জীবিকাতে তাদের যে ভূমিকা তা কি জীবনে প্রতিফলিত হয় না? প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। একটা কথা খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। চেয়ারের সুবাদে মানুষের পরিচয় কি যথার্থ? চেয়ার গেল তো পরিচয়ও গেল? আমার এক শুভাকাঙ্খী বলত, "চেয়ার ছাড়ার পরও যারা একই রকম সম্পর্ক রাখবে, জানবি তারাই তোর জীবনের বন্ধু। বাকিরা সব জীবিকার খাতিরে তোর কাছে আসত। তাদের কাছে তুই প্রয়োজন, প্রিয়জন নয়।" যখন কথাটা শুনেছিলাম তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই কথাগুলোর সত্যতার প্রমাণ পেয়ে এসেছি। কত চেনা মানুষের অচেনা মুখ লক্ষ্য করেছি। যাদের খুব প্রিয়জন বলে ভেবেছি, আত্মীয় বলে ভেবেছি তাদের অন্য রূপে খুঁজে পেয়েছি। তাহলে, কি প্রমাণ হল? এতদিন ধরে মেনে আসা বিষয়টাই কি ঠিক নয়? এখন তো চারিদিকে শুধু জীবিকার ঢক্কানিনাদ! বিদ্যার্জনের জন্য লেখাপড়া বাদ দিয়ে জীবিকার্জনের জন্য লেখাপড়া হচ্ছে। জীবিকানির্ভর জীবনের স্রোত নানারকম শ্যাওলায় আটকে গতি হারাচ্ছে। এমনকি বিপরীতমুখীও হচ্ছে। আমি যে আমি, এত কথা বলছি, আমিও কি পারছি সময়বিশেষে জীবিকাকে জীবন থেকে সরিয়ে রাখতে? একটা সময় ছিল যখন দিনরাতের প্রায় সমস্ত সময়টায় (ঘুমনোর সময় বাদ দিয়ে। অবশ্য তাও অনেক সময় পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ।) জীবিকাকে নিয়েই আমাকে মেতে থাকতে হত। তো, আমিও বাদ নেই তালিকা থেকে। আসলে পরিবেশ আর পরিস্থিতি বাধ্য করে দিচ্ছে জীবন আর জীবিকাকে মিশিয়ে দিতে। ইঁদুরদৌড়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে সবাই এমনই করে চলেছে। চারদিকে এত প্রতিযোগিতা, এত উচ্চাকাঙ্খা, এত মূল্যবোধের অবক্ষয়! এর থেকেই জন্ম নিচ্ছে নানারকম জটিল মানসিক রোগ। সে রোগ যে শুধু মানসিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে তাই নয়, নষ্ট করছে মানবিক প্রতিষ্ঠাও। চাহিদা আর আকাঙ্খা বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে আমরা জীবন ভুলে জীবিকার পিছনে ছুটছি। জীবনের মূল্যবোধের জায়গা নিচ্ছে জীবিকার চটকদারি। যতদিন না চাহিদা আর আকাঙ্খার এই উর্ধগতির রাশ টানা যাচ্ছে ততদিন এরকম রোগে ভুগতেই হবে আমাদের। এর শেষ কোথায়? উত্তর জানা নেই।

{ads}

news literature short story Bengali Short story story life and it's realizations Realization Indian Railways poet feature গল্প ছোটগল্প প্রবন্ধ উপলব্ধি নিখিল কুমার চক্রবর্তী

Last Updated :

Related Article

Care and Cure 1

Latest Article