header banner

উপলব্ধিঃ ফুটপাতের গল্প- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

যাওয়া আসার সময় রাস্তার দুপাশে ফুটপাতের ওপর প্ল্যাস্টিকের ফ্লেক্সের ছাদ তৈরি করে অনেক পরিবারের যাপন দেখেছি। এই ছাদের নীচেই তাদের দিন শুরুর হাসি, দিনান্তের লড়াই, নবজাতকের আগমন প্রক্রিয়া, স্বভাবসিদ্ধ কলহ বিবাদ, থান ইঁটে মাথা ঠেকিয়ে গুটিয়ে শুয়ে রাতকাবারের স্বপ্ন। দেখেছি এই ছাদগুলোতেই সব রঙের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। লালের ফ্লেক্সের ছাদের পাশেই সবুজের ফ্লেক্সের ছাদ, তার পাশে গেরুয়া, তার পাশে নীল ইত্যাদি। দেখতে দেখতে ভাবি, সত্যিই 'শেষ হইয়াও হইল না শেষ'। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলেও বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স কারোর মাথার ছাদ হয়ে বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। সংসারের সুখে প্লাবিত হচ্ছে কিছু পরিবার। ফ্লেক্স ব্যবহারের এর চেয়ে ভালো উপকারিতা আর কিসে আসতে পারে? তবে কখনও কখনও যাতায়াতে অসুবিধে হলে বিরক্তি যে আসে না তা নয়। ফুটপাত জুড়ে যদি এমন সাংসারিক চালচিত্র বিরাজ করে তাহলে হাঁটা চলা করা মানুষগুলোকে তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়! মনে মনে বলি, কেন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এভাবে ফুটপাত দখল হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন! বড় বড় বিল্ডিংয়ের দৌলতে রোদ চুরি তো হয়েই গেছে! এবার ফুটপাতও যাবে? আমরা আর কি নিয়ে আঁতলেমি করব তাহলে? ফুটপাতই তো গল্প, কবিতা, প্রতিবাদের আঁতুড়ঘর। দিন যত এগোয় তত পরিণত হতে থাকি, বুদ্ধিমান হতে থাকি। আস্তে আস্তে অনেককিছুর মত এক্ষেত্রেও সমঝোতা করতে শিখে যাই। সবকিছু বাঁচিয়ে এগিয়ে যাওয়া রপ্ত করে নিতে শিখি। যে কোন ঝড় বৃষ্টির দিনে মনের অবস্থা কিন্তু পাল্টে যায় একেবারে। এদের অনেকের ছাদ উড়ে অথবা ছিঁড়ে যেতে দেখি। ওদের ভগ্ন নীড় দেখে কষ্ট হয়, বিচলিত হই। তখন ছাদের নীচের লোকগুলো সরাসরি আকাশের নীচে চলে আসে। মাথা বাঁচানোর কি আপ্রাণ চেষ্টা, কি আন্তরিক আকুতি! শুধু মাথা বাঁচানো কেন, ফুটপাতের সংসারের আবশ্যিক জিনিষগুলো কিভাবে রক্ষা করা যায় তার চিন্তায় আকুল মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না তখন। এরকমই এক ছাদের নীচে এক বৃদ্ধাকে দেখতাম সবসময় হাতে একটা ছোট্ট রেডিও নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে কি যেন শুনে যেত। কি শুনছে বোঝার চেষ্টা করে বিফল হতাম। রেডিও থেকে শুধু ঘ্যারঘ্যারে আওয়াজ। সেই আওয়াজ শুনেই মহিলাকে দেখতাম মাঝে মাঝে বিজ্ঞের মত মাথা নাড়তে। কখনও আবার হাপুস নয়নে কাঁদতেও দেখতাম। এক যুবককে দেখতাম মহিলার সামনে খাবারের থালা ধরে সযত্নে খাইয়ে দিতে, মুখ হাত ধুইয়ে দিতে। বাচ্চার আচরণে যুবককে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মহিলাকে আবার রেডিওতে মগ্ন হতে দেখতাম। বেশ কয়েকবার দেখে বুঝেছিলাম এটা মা ছেলের রসায়ন। এই ভেবে ভাল লাগত যে মা ছেলের চিরন্তন সম্পর্কের জলছবি এখনও দেখা যায়। একদিন তুমুল ঝড়বৃষ্টির পর ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম যথারীতি আকাশ ওদের মাথার ছাদ হয়ে গেছে। তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। যুবকটি একটা ভাঙা ছাতা নিয়ে মায়ের মাথায় ধরে আছে। মা তখনও নিমগ্ন রেডিওর আওয়াজে। ভাবলাম, এই তো আমার দেশের প্রতীকী ছবি। স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা আর বিশ্বাস একসাথে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গলে পড়ছে যেন। এক আকাশ তৃপ্তি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। সে তৃপ্তি অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ফুটপাতের অন্য চিত্র সামনে উঠে এসেছিল। এই পরিবারগুলো আর যাইহোক তৃপ্তিহন্তা হতে পারবে না কখনও। এরা নিজেদের যাপন নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য কারোর জীবন দুর্বিষহ করার ইচ্ছা বা মানসিকতা কোনটাই ওদের নেই। সংবাদ মাধ্যমে দেখেছিলাম এক অসুস্থ বৃদ্ধাকে তার সন্তান কখন যেন চুপিচুপি রাস্তার ধারের ফুটপাতে শুইয়ে রেখে দিয়ে চলে গেছে। না না, একেবারে ফুটপাতের শক্ত কংক্রিটের ওপর নয়। একটা কম্বল দয়া করে বিছিয়ে তার ওপর জননীকে শুইয়ে রেখে গেছে। অভুক্ত, নির্বাক, অভিযোগহীন মা জানেই না তার অপরাধ কি? অনেক জিজ্ঞাসা করেও কেউ জানতে পারল না মহিলার সন্তানের নাম, বাড়ির ঠিকানা। সন্তানের বদনাম হোক তা জননী কি করে মেনে নিতে পারে? সেই ফুটপাতেই এক অন্য চিত্রের ক্যানভাস দেখলাম। এক অন্য জীবনের আখ্যান।

{ads}

Literature essay bengali story expert's opinion news feature Nikhil Kumar Chatterjee সংবাদ ফিচার গল্প বাংলা প্রবন্ধ প্রবন্ধ ফুটপাত ফুটপাতের গল্প

Last Updated :