header banner

উপলব্ধিঃ লোকাল ট্রেন- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

উপলব্ধি 
(লোকাল ট্রেন)

হাওড়া বা শিয়ালদা শাখার লোকাল ট্রেনে যে চাপেনি তার জীবন বৃথা। এত বিচিত্র এবং অবাক করা মানবজমিন আর কোথাও পাওয়া যায় বলে আমার অন্তত জানা নেই। বিভিন্ন দ্রব্যের ফেরিওয়ালা বা হকার তো আছেই। (পাঠক, দ্রব্য বলতে গানকেও বুঝুন) দুটো স্টেশনের মাঝের সামান্য সময়টুকুতে প্রতিটা যাত্রীর কানে তার দ্রব্যের গুণাগুণ ঠুসে দেওয়া এবং তার সাথে নিজের দ্রব্যটি গছানোর এমন সুন্দর কেতা খুব কম দেখেছি। বড় বড় কোম্পানিগুলো সেলস আর মার্কেটিংয়ের জন্য আলাদা আলাদা লোক রাখে। বিভিন্ন দ্রব্যের কাউন্টার বা শপও আলাদা। এখানে চলমান শপ নিয়ে একজনই সেলস আর মার্কেটিংয়ের কাজ করে যায়। এছাড়াও আছে বিশেষজ্ঞের ছড়াছড়ি। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের ব্যাপারে বলছি না। সবাই সবকিছু জানে। মাস্টারি, খেলা, ডাক্তারি, আইনের মারপ্যাঁচ, রাজনীতির দাওপ্যাঁচ, সিনেমার অলিগলি, নেতা নেত্রী বা "অভি" যুক্ত নেতা নেত্রীর নাড়ি নক্ষত্র জানে না এমন যাত্রী খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। সবাই বিশেষজ্ঞ। কে যেন বলেছিল, এরা সবাই বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। সব চেয়ে যা আকর্ষণীয় তা হল, এদের মধ্যে যারা বিনা টিকিটে যাত্রা করার দক্ষতা অর্জন করেছে তারা কি করে যেন টিটিই আসার গন্ধ পেয়ে যেত। ঠিক সময়ে সুরুৎ করে সরে পড়ত। একটা কাপড়ের টুকরোর চারটে খুঁটে চারটে দড়ি বাঁধা। তা মুখোমুখি বসা চারজনের পায়ে টান টান করে জড়িয়ে নিলেই মাঝখানে তাস পেটানোর টেবিল। তাতে বেশ মনোযোগ দিয়ে টুয়েন্টি নাইন বা কলব্রিজ চলছে, হঠাৎ সব গুটিয়ে বাটিয়ে ধাঁ। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাজ বা সাহিত্যের অবহেলিত চরিত্র সাদা প্যান্ট, কালো কোট পরে হাজির। কত কিছু যে শেখা যায় এই লোকাল ট্রেনে! একদিন এইরকমই এক যাত্রায় অসাধারণ এক শিক্ষালাভ করলাম। কয়েকজনের মধ্যে ধুম তর্ক চলছে। বিষয় পরকীয়া। ক্রমশ বিষয়টা নারী পুরুষের চিরন্তন তুলনায় পৌঁছে গেল। অর্থাৎ নারী না পুরুষ, কে বেশি পরকীয়া চায়? একজন (প্রথম জন) বলল-
--সব শালার মনে পরকীয়ার ইচ্ছে আছে। এমন কোন পুরুষ নেই যে পলিগ্যামি চায় না। আর চায় বলেই পরকীয়ায় মাতে।
অন্যজন (দ্বিতীয়জন) বলল
--মেয়েরা বুঝি পরকীয়া চায় না? না চাইলে পুরুষগুলো কার সাথে পরকীয়া করে? পরকীয়া চাওয়া পুরুষগুলো কি সব অবিবাহিতাদের সাথেই শুধু মাতে?
আরেকজন (তৃতীয়জন) বলল
--নিশ্চয়ই মেয়েরাও চায়। তারা তো আর প্রকৃতির বাইরে নয়। তাছাড়া নারীকে তো প্রকৃতির সাথে তুলনা করা হয়। সেই প্রকৃতিই একটা ঋতু নিয়ে সারাবছর থাকতে পারেনা। বছরে ছটা চাই তার। তা, নারী কি করে একটা পুরুষে সন্তুষ্ট থাকবে?
চতুর্থ আরেকজন বলল
--রাজারাই তিন চারটে রানি রাখত। দ্রৌপদী ছাড়া কারোর একের বেশি হাজব্যান্ডের কথা শুনিনি। তাও দ্রৌপদীকে বাধ্য করা হয়েছিল।
তৃতীয়জন উত্তর দিল
--তখন নারীরা ঘরবন্দী থাকত। তাই সুযোগ কম ছিল তাদের। এখন যত বাইরে বেরুচ্ছে তত সুযোগ বাড়ছে, সঙ্গে ইচ্ছে। তারাও পরকীয়ায় মাতছে।
প্রথমজন গম্ভীর হয়ে বলল
--পরকীয়ার আরো একটা বড় কারণ হচ্ছে অকারণ অভাববোধ। এত জেটযুগে বাস করছি আমরা যে কিছুতেই মনে শান্তি আসে না। আরো ভাল চাই, আরও সুন্দর বা সুন্দরী চাই। ঘরকা মুরগা ডাল বরাবর!
গাড়ি হাওড়া স্টেশনে ঢোকার আগে দ্বিতীয়জন উপসংহার টানতে চাইল
--বিভিন্ন ছোলাতে বিভিন্ন রং লাগালে কি ছোলার নাম পাল্টায় না টেস্ট পাল্টায়? অভাব বোধটোধ কিছু নয়। আসলে সবকিছুর মূলে হল স্বভাব। ঐ যে দাদা বললেন না, সবার মনেই পরকীয়ার ইচ্ছে আছে। কেউ সাহস করে এগোয়, কেউ এগোয় না। এতে নারী, পুরুষ আলাদা করার কোন মানে হয়না।
ট্রেন থেকে নামতে নামতে পঞ্চমজন মুখ খুলল (এতক্ষণ নীরব শ্রোতা ছিল)
--জান কি, পায়রা কখনও পরকীয়া করে না। নিজের পুরুষ বা নারী ছাড়া অন্য কারোর সাথে সহবাস করে না। সবাইকে "স্বভাব" দোষের কবলে ফেলাটা ঠিক নয়, বুঝলে? এই জগতে বেশিরভাগ মানুষই পায়রার মত। 

{link}
ট্রেন থেকে নেমে নিজের কাজে চলে গেলাম। নির্দিষ্ট সময়ে ফিরেও গেলাম। পরের দিন যাওয়ার সময় আবার সেই লোকগুলোর সাহচর্য। আবার আলোচনা, বিশেষজ্ঞের মতামত। আশ্চর্যের বিষয়, কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই, গতকাল তারা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছে। এদিন শুরু হল, আকাশ চোপড়া ক্রিকেট দুনিয়ায় না এলে কি চরম সর্বনাশ হয়ে যেত ভারতীয় ক্রিকেটের! সত্যিই লোকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট আজব জগতের একটা টুকরোই বটে।

{ads}

story short story literature essay realization Nikhil Kumar Chatterjee Bengali story bengali short story গল্প প্রবন্ধ ছোট গল্প সাহিত্যের পাতা লোকাল ট্রেন প্রবন্ধ

Last Updated :