ছোটবেলায় লম্বা ছুটিতে বছরে কমপক্ষে তিনবার গ্রামের বাড়িতে আমরা অবশ্যই যেতাম। 'হাপেয়ালি' আর 'এনুয়ালি' পরীক্ষার পর আর একবার বারোয়ারি কালীপুজোর সময়। চাকরি সূত্রে বাবা আমাদের নিয়ে অন্যত্র থাকায় এই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আনন্দটা আমার কাছে বৃষ্টির রিমঝিম নূপুর নিক্কণ বা পলাশের আগুন আহ্বানের মত ছিল। উৎসুক হয়ে থাকতাম, কবে বাবা গ্রামে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলবে। গ্রামের বাড়িটায় চারদিকে গোল করে খড়ের শিরোস্ত্রাণ সমৃদ্ধ মাটির পাঁচিলের চৌহদ্দি ছিল। এই মৃত্তিকাবলয় লাগোয়া এক একটা খড়ের চালের ঘর মাথা উঁচু করে থাকত। প্রত্যেকটা ঘর আলাদা আর তাদের এক একটা নাম। বড় ঘর, নতুন ঘর, সদর ঘর, কল ঘর, হেঁসেল ঘর। ঘরগুলোর সামনে একটা টানাবারান্দা ছিল। নাম বা স্থান আলাদা হলেও ঘরগুলোকে যেন এক সূতোয় গেঁথে রাখত বারান্দাটা। ঘরগুলো এক চৌহদ্দির ভেতরে আটকে থাকত। বাছবিচার না করে সবাইকে আশ্রয় দিত। একদম মাঝখানে ছিল বিরাট একটা উঠোন। সেখানে দু তিনটে ধানের মরাই সবসময় বাঁধা থাকতে দেখতাম। এরপরেও উঠোনে যা জায়গা থাকত তা আমাদের ডানপিটেমিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। মামা বাড়িতেও এই সময় আমরা একবার করে ঘুরে আসতাম। মামাবাড়ির গঠনও প্রায় একরকম ছিল। শুধু পাশাপাশি দুটো মামাবাড়ি ছিল। একটাতে দাদু দিদিমার সাথে সেজ আর ছোট মামা, অন্যটায় বড় আর মেজ মামা। পরিবার সমেত। দুটো বাড়ির উঠোনই আমাদের লীলাক্ষেত্র। আমরা যাওয়া মানেই সেজ মাসি, মেজ মাসি বড় মাসি তাদের পোলাপান নিয়ে হাজির হত। সে যেন এক সব পেয়েছির হাট।
{link}
চোখের সামনে আস্তে আস্তে বড় চৌহদ্দি ভেঙে ছোট ছোট পাঁচিলের ঘেরা গড়ে উঠতে লাগল। যত পরিবার তত চৌহদ্দি। বাল্যবিধবা পিসিমা দুই ছেলে নিয়ে আমাদের বাড়িতে থাকত। আলাদা বাড়িতে চলে গেল। জন্মসময়ের বিচারে তার দুই ছেলে আমাদের বড়দা আর মেজদা। এইভাবে আমরা আট ভাই। সেজদা, ন'দা, নতুনদা, ফুলদা, ছোটদা এবং সবশেষে আমি, রাঙা। বড়দা, মেজদা দু ভাইএর প্রথমে আলাদা চৌহদ্দি হল। তারপর বড় জেঠার তিন ছেলের একটা চৌহদ্দি, মেজ জেঠার দুই ছেলের একটা আর আমার ভাগের একটা। সেখান থেকেও আবার ভায়ে ভায়ে ভাগ, তস্য ভাগ। ডানপিটেমির উঠোন, লীলাক্ষেত্রের উঠোন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। মামা বাড়ির উঠোন ভাগ হতে হতে এত টুকরো হল যে এখন একটা পাড়া হয়ে গেছে। একান্নবর্তী বিলুপ্ত হয়ে এখন হয়েছে "একা অন্নবর্তী"।
{link}
আজ এই পড়ন্ত জীবনে এসে বড্ড খুঁজে বেড়াই সেই বিশাল উঠোনটা, আমাদের সেই খেলার মাঠটা। খুঁজে বেড়াই তামর হেম্ব্রম, রঘুনাথ দাস, আশিনন দিদি, শ্যামল মোদকের মত অনেককে। আজ যখন দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে আলাদা হওয়ার আওয়াজ শুনি, এক রাজনীতিককে না মানতে পেরে অন্য রাজনীতিকের বলয় থেকে ছিটকে যাওয়া দেখি তখন আমাদের সেই উঠোনটার কথা বড় বেশি করে মনে পড়ে। বাবার কথা মনে পড়ে। "একটা সংসার একটা শরীরের মত। সব অঙ্গগুলোর সমান গুরুত্ব। তবে মাথা যেহেতু শরীরটা চালায় তাই তার গুরুত্ব একটু বেশি। তাকে বেশি মান্যতা দিতেই হয়। প্রয়োজনে অন্যদের স্বার্থত্যাগ করতে হয়।" হায় রে! আজ সবাই সমান গুরুত্বের দাবীতে সোচ্চার। মাথাও পরিচালনার দায়িত্ব ভুলে নিজস্ব ক্ষমতার দম্ভে সব অঙ্গকে ব্রাত্য করে রাখায় মগ্ন। সাধারণ মানুষ যদি জীবন রাখতে হিমসিম খায়, সূর্য ওঠা থেকে ডোবা পর্যন্ত কিভাবে বেঁচে থাকবে তার চিন্তাতেই মগ্ন থাকে তাহলে ধরিত্রী কিভাবে বাঁচবে? আজ যখন নায়কে নায়কে, নেতায় নেতায় বাক যুদ্ধ দেখি, বিভিন্ন মিডিয়ায় বুদ্ধিজীবীদের হাজার বিষয়ে তর্ক বিতর্ক দেখি তখন মনে হয় এরা কি জানে না "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়"! আমজনতার খিদে না মিটিয়ে আমের রস নিংড়ে আঁটি ফেলে দিলে সেই আমের বীজ কি আর ভবিষ্যতে ভাল ফল দেওয়া গাছের জন্ম দেবে? "হয়ত তাহাই, হয়ত নহে তা"। তবুও আমার মত কিছু 'মিসফিট' লোক এখনও দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে, ঘরে ঘরে 'একান্নবর্তী'র স্বপ্ন দেখে যায়। বোঝে না, যতদিন না, 'আমি এবং আমার' খোলস ছাড়তে পারা যাচ্ছে ততদিন এই স্বপ্ন সাকার হওয়া সম্ভব নয়। সাপও বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পুরনো খোলস ত্যাগ করে নতুন খোলস তৈরি করে নেয়। আমরা কেন নিজেদের তৈরি করা খোলস ত্যাগ করতে পারব না? নতুন রূপে পুরনো প্রথা শুরু হোক না! আবার শুরু হোক, সবাইকে নিয়ে একসাথে বাঁচা, একসাথে বিপদ কাটানো, একসাথে পথচলার কাহিনি। একান্নবর্তী মানে তো আর একছাদের নীচে থাকার শর্তধীন বিধিনিষেধ নয়। একান্নবর্তী মানে এক অন্ন সবাই মিলে ভাগ করে নেওয়ার নীরব প্রতিশ্রুতি, একের বিপদে অন্যের পাশে থাকার নির্বাক অঙ্গীকার আর সর্বোপরি একজন কে ছোট করে অন্যজনের বড় হওয়ার প্রয়াস নয়--বরং এক আকাশ সামীয়ানার নীচে ছোট বড়, উঁচু নীচু সবার মাথা তুলে শ্বাস নেওয়ার রোজনামচা।
{link}