উপলব্ধি
(ভয়ের ব্যবসা)
আমার এক এল আই সি এজেন্ট বন্ধু আমাকে বলেছিল,"পৃথিবীতে সবচেয়ে ভাল বিক্রয়যোগ্য প্রোডাক্ট হল ভয়। ভয়ের মত ভাল মার্কেট আর কোন প্রোডাক্টের নেই।" বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয়েছিল। এমন প্রোডাক্টের কথা আগে কখনও শুনিনি যে! ভয় দেখিয়ে ব্যবসা করা যায় জানতাম, ভয়কে প্রোডাক্ট করে ব্যবসা করা যায়, জানতাম না। যথারীতি, তর্ক করেছিলাম বন্ধুর সাথে। সে তখন বলেছিল, "জামাকাপড়ের ব্যবসা চলে মানুষের লজ্জাশরমের ভয়ে, মুদিখানার দোকান চলে খেতে না পেয়ে মরার ভয়ে, স্কুলের ব্যবসা চলে লেখাপড়া না শিখলে চাকরি না হওয়ার ভয়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। যেখানে ভয় যত বেশি সেখানে ব্যবসাও তত বড়।" আমার মাথায় বসে গিয়েছিল কথাগুলো। ব্যবসাগুলোকে এমনভাবে কোনদিন চিন্তাই করি নি। সত্যিই তো! বন্ধু নিজে যে কাজটা করে তা নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর ভয়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের মৃত্যুভয় আছে বলেই লাইফ ইনসিওর করায়। না হলে, কি প্রয়োজন! বিভিন্ন কাজের পর্যালোচনা করতে গিয়ে মনে হল প্রতি কাজেই কম বেশি ভয়ের এলিমেন্ট জড়িয়ে আছে। বড় বড় ব্যবসাতে ভয়ই নম্বর ওয়ান প্রোডাক্ট। তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ল আজকাল উবের ট্যাক্সি বুক করতে গেলে একটা ঝামেলা হচ্ছে। ড্রাইভার ফোন করে ড্রপিং পয়েন্ট জানতে চাইছে। যখনই ডেস্টিনেশন তার পছন্দমত হচ্ছে না তখনই বুকিং ক্যানসেল করে দিচ্ছে। কোন কোন সময় তিন চারটে ক্যানসেল হওয়ার পর একজনকে পাওয়া যাচ্ছে। বড় তাড়ার সময় এতে ভীষণ রাগ হলেও চুপচাপ সহ্য করে নিতে হয়। অনেকসময় ড্রাইভার সরাসরি বলে দেয় যে, যা ভাড়া দেখাবে তার থেকে ১০০/২০০ টাকা বেশি দিতে হবে। একে তো গাড়িতে এ সি চালাবে না (শুনেছি ভারত ছাড়া অন্য সব দেশে উবের এ সি সার্ভিস দেয়) তার ওপর ভাড়া বেশি চাইবে! সে যাই হোক, এখানেও সেলেবল প্রোডাক্ট কি ভয়? ড্রাইভার কিসের ওপর নির্ভর করে এত মেজাজ দেখায়! একটু চিন্তা করতেই ব্যাপারটা বোধগম্য হল। হ্যাঁ, এখানেও সেই ভয়! তাড়াতাড়ি পৌঁছতে না পারলে অফিসে লেটমার্ক হবে বা ট্রেন ছেড়ে বেরিয়ে যাবে বা প্রিয়জনের সাথে দেখা হবে না এবং আরো অনেক কিছু। তাই কেউ প্রতিবাদ করে না সহজে। রাগ হলেও চুপচাপ মেনে নেয়। কিন্তু এটাও ঠিক, যেদিন এই ভয়ের ব্যাপারটা থাকবে না সেদিন এই উবের ড্রাইভার বা মালিকদের অবস্থা হলুদ ট্যাক্সির ড্রাইভার বা মালিকদের মত হবে। আজকাল রাস্তাঘাটে হলুদ ট্যাক্সির জায়গা উবের/ওলা নিতে পেরেছে এই কারণেই। কাস্টমারের যে ভয়কে মূলধন করে হলুদ ট্যাক্সিওয়ালারা যা খুশী তাই দর হাঁকত বা মর্জিমত প্যাসেঞ্জার তুলত গাড়িতে, সেই ভয়ের থেকে মুক্তি পেতেই মানুষ উবের/ওলাকে সানন্দে গ্রহন করেছিল। আজ সেই একই রাস্তায় উবের/ওলা হাঁটলে মানুষ এই ভয়েরও বিকল্প খুঁজে নেবেই। হ্যাঁ, সেখানেও ভয় থাকবে। তবে সান্ত্বনা একটাই যে, ভয়ের থেকে কিছুদিনের জন্য হয়ত রেহাই পাওয়া যাবে। তা, এ তো না হয় ট্যাক্সিভাড়া নিয়ে ভয়ের ব্যাপার! কেটে যাবে একদিন। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে? আমরা ভয় পাই বলেই না অযোগ্য, অপাত্র লোকজন আমাদের মাথায় উঠে নাচে! পাড়ায় থাকতে হবে তো না কি! ছেলেপুলে নিয়ে শান্তিতে থাকতে হবে তো! সুতরাং পাড়ার "দাদা" কপাল ফাটা কেতোদাকে ঘেঁটু পুজোর চাঁদাটা দিয়েই দিই। সেই কেতোদা আবার যখন নির্বাচনে বেগুনী দলের প্রার্থী হল তখন আর একটু ভয় বেড়ে গেল। ওরে বাব্বা, এবারে তো ওর মাথায় রাজনীতির ছাতা! আর কে না জানে, রাজনীতির চেয়ে বড় ব্যবসা আর কিছু নেই। সুতরাং কেতোদাও আমাদের ভয়কে মূলধন করে রাজনীতির ব্যবসা করতে নেমে পড়ল। এল আই সি এজেন্ট বন্ধু বলেছিল, "শোন, যত ওপরের দিকে যাবি, তত বুঝবি ভয়ের মত এত ভাল প্রোডাক্ট আর কিছু নেই। সে প্যারাসিটামল হোক, অথবা এন্টাসিড অথবা কন্ট্রাসেপটিভ পিল, ভয় আছে বলেই বাজারে হুড়মুড় করে বিকোয়। এমনকি ফেল করার ভয় আছে বলেই প্রাইভেট টিউশনের এত রমরমা!" ওকে সেদিন বলতে পারিনি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, ভয় দেখিয়ে তো মন্দির, মসজিদ, গীর্জা ইত্যাদিও চলছে। এখনও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে ভক্তিভরে তাবিজ, ঘুনশি পরানো শ্রেয় মনে করে অনেকে। না হলে আকাশ থেকে অভিশাপ নেমে আসতে পারে যে! যেদিন সত্যি ভয়শূন্য জীবন হবে সেদিন ব্যবসার নামে শোষনও শেষ হবে। তা সে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। প্রশ্ন শুধু একটাই, যে জেগে ঘুমোয় তার ঘুম ভাঙাবে কে? ভয় নিয়ে যার বিলাস তাকে চেতনার জগতে আনবে কে?
{ads}