header banner

উপলব্ধিঃ সম্পর্ক- সম্পর্ক- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

উপলব্ধি 
(সম্পর্ক)

খুব ছোট্টবেলায় পড়াশোনার পাঠ আমাদের ছিল না বললেই চলে। বাবা মায়ের কাছে শোনা, প্রথম ইস্কুলে গিয়েছিলাম পাঁচ বছর বয়সে। ইনফিন ক্লাসে। সেখান থেকে ডবল প্রমোশন পেয়ে এক লাফে ক্লাস টু তে। ঐ সময়েই শিখেছিলাম, ইস্কুলে মাস্টারমশাইরা সবাই গুরুজন। তাঁরা যা বলবেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়। এমন কি রোজ নিয়ম করে গাঁট্টা বা বেত্রাঘাত দিলেও মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। আর সহপাঠীরা সবাই বন্ধু। তাদের সাথে সবকিছু শেয়ার করতে হয়। মিলেমিশে থাকতে হয়। সহপাঠী মানে শুধু নিজের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নয়। নীচে বা ওপরের ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও সহপাঠী এবং বন্ধু। তাই করতামও আমরা। আজও তাই সেইসব মাষ্টারমশাই বা সহপাঠীদের সাথে সুসম্পর্ক বর্তমান। এখন চারিদিকে অন্যচিত্র। মাষ্টারমশাইদের গুরুজন মানা হয় কি না, জানি না। তবে ছাত্র ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলার অধিকার তাঁদের নেই। রে রে করে লোকাল দাদা, জাতীয় নেতা, মানবাধিকার কমিশন, মিডিয়া ইত্যাদি যত প্রতিষ্ঠান বা পরিত্রাতা আছে সবাই টি আর পি বাড়ানোর ময়দানে নেমে পড়বে। এখন সবাই জানে, পাবলিকে কি খায়! যা খায়, তাই খাওয়াতে হবে তো না কি! সহপাঠীরাও কেউ বন্ধু নয় এখন। প্রতিযোগী। কারোর সাথে কিছু শেয়ার করতে নেই। তাহলে সেও ভাল নম্বর পেয়ে যাবে। প্রতিযোগী তৈরি হয়ে যাবে। এখন কেউ চায় না, ময়দানে তার কোন প্রতিযোগী থাকুক। সে ইস্কুল, চাকরির জায়গা বা রাজনীতির ময়দান যাই হোক না কেন! নারী পুরুষের সম্পর্কও আর নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস বা ভরসার সম্পর্কে আটকে নেই। সভ্যতার ঝকমকানিতে সে সম্পর্কেও এখন পারস্পরিক বোঝাপড়ার চেয়ে পারস্পরিক স্বার্থসিদ্ধির আগ্রহ বেশি। এই সম্পর্কটা অনেকটা দাঁত আর জিভের মধ্যেকার সম্পর্কের মত হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই একে অপরকে কামড়ে দেয় বা আঘাত দেয়। দাঁত যেমন সুযোগ পেলেই জিভের রক্ত বের করে দেয়, তেমনি দাঁত দুর্বল হলেই জিভ তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে দাঁত আর জিভের মধ্যে কোনটা নারী আর কোনটা পুরুষ তা নির্ধারণ করা খুব কঠিন। দাঁত যেহেতু জিভের পরে জন্মায়, মানে, জিভের থেকে বয়সে ছোট তাই সামাজিক নিয়মে দাঁতকেই নারী ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া, চরিত্রগত মিলের জন্যও দাঁতকেই নারী ভাবা বাঞ্ছনীয়। আর একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। নারী পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টাতেই সমাজ বা সংসার টিকে থাকবে এ বিষয়ে দ্বিমত থাকা উচিত নয়। আগেকার সম্পর্কে পুরুষ বহির্জগতে ব্যপ্ত থাকলে নারী অন্দরমহল সামলাত। এটা "ডিভিশন অব লেবার" ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হত বেশি। এখন দুজনেই বহির্জগতে ব্যপ্তদ হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে না তো? "ডিভিশন অব লেবার" যে আমাদের সমাজে সম্পর্ক তৈরিতে অনেককটাই ভূমিকা নিত বা নেয় তা অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই। সেই মুনি ঋষিদের সময়েই "ডিভিশন অব লেবার" এর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল "বর্ণাশ্রম" প্রথা। লেখাপড়া শেখা বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণরা পুজোআচ্চার কাজ করবে, শারীরিকভাবে শক্তিশালী ক্ষত্রিয়রা দেশ রক্ষার কাজ করবে, বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন বৈশ্যরা ব্যবসাবানিজ্য করবে, আর বাকিরা সব শূদ্র। তারা অন্যান্য কাজ করবে। এমন কি এদের বৈবাহিক সম্পর্কও নিজেদের গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ও সব বালাই নেই। ব্রাহ্মণ সন্তান দেশরক্ষার কাজ করছে আবার ব্যবসাবানিজ্যও করছে। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য সবাই সবার কাজ করছে। তাহলে বৈবাহিক সম্পর্কও শুধুমাত্র নিজেদের গ্রুপে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। থাকছেও না। অর্থাৎ, এক্ষেত্রেও সম্পর্কের সজ্ঞা পাল্টাচ্ছে। যুগোপযোগী হচ্ছে সম্পর্ক। তাই যদি হয়, তাহলে ইস্কুলে, চাকুরিস্থলে, রাজনীতির ময়দানে সর্বত্র সম্পর্ক যে অনেকটা প্রতিযোগীতামূলক হয়ে যাচ্ছে তাও কি সময়ের দাবীতে? মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর বা মানুষের সাথে প্রকৃতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আর বোঝাপড়ার সম্পর্কের বদলে শুধুই কি স্বার্থসুখের সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকব আমরা? এতে "ইকোসিস্টেম" বজায় থাকবে তো? বজায় থাকবে তো প্রকৃতিনির্ভর মানবের সমাজ আর সভ্যতা? মনে হয়, কেউই এর উত্তর খুঁজতে আগ্রহী নয়। আগ্রহী হলে সম্পর্কের চরম অবনতি নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হত না। পাঁচ বছরের শিশুকন্যাকে তার বয়স্ক আত্মীয়ের ধর্ষণের বা পুত্র অথবা কন্যার হাতে পিতা/মাতা খুন হওয়ার খবর পরেও আমরা নিশ্চুপ থাকতাম না। এ এক অবক্ষয়ের সম্পর্কের, মূল্যবোধহীনতার সম্পর্কের আবর্তে ঘুরে মরছি আমরা।

news literature Story realization bengali literature essay West Bengal India relatio গল্প উপলব্ধি সংবাদ সাহিত্যের পাতা

Last Updated :