header banner

উপলব্ধিঃ নিয়মের গেরো- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

উপলব্ধি 
(নিয়মের গেরো)

অনেক জায়গায় কাজ করতে বা করাতে গিয়ে একটা বিশেষ কথার মুখোমুখি হয়নি এমন লোকের সংখ্যা এই পোড়া দেশে হাতে গোনা যায়। বিশেষ কথাটা হল, "কি করব বলুন, রুল পারমিট করছে না"। বদ লোকেরা একেই বোধহয় "লাল ফিঁতের ফাঁস" বা "নিয়মের গেরো" বলে উপহাস করে থাকে। তা, বদ লোকেরা বদ মন্তব্যই তো করবে! আমরা সে প্রসঙ্গে যাব কেন? নিয়ম তো থাকবেই। সব কাজের একটা নিয়ম থাকাই বাঞ্ছনীয়। না হলে সুষ্ঠু ভাবে কাজটা সম্পন্ন হবে কি করে? মনে করা যাক, কোন এক জায়গায় সরকারি টাকায় পাকা রাস্তা বা বাড়ি তৈরি হবে। তার জন্য প্রাথমিক কাজগুলো নিয়ম মেনে করতে হবে বৈ কি! যেমন, এস্টিমেট তৈরি করা, টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করা, টেন্ডার কল করা, টেন্ডার জমা পড়ার পর তা স্ক্রুটিনি করা, লোয়ার ভ্যালুর টেন্ডারারকে কাজটা সম্পন্ন করতে ডাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। নিয়মগুলো সিরিয়ালি মেনটেন করা দরকার। এখন, এসব নিয়ম কাগজে কলমে পালন করতে গিয়ে "ক" বাবুকে পছন্দ না করে "গ" বাবুকে বেশি ভালবাসলেই মুশকিল। "গ" কে ভালবাসার উত্তাপ বোঝানোর জন্য তখন "ক" কে লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রাখাটাই দস্তুর। তখনই নিয়ম চারিদিকে শাখা প্রশাখা মেলতে থাকবে। নিয়মের থেকে ব্যতিক্রম তখন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আর এই বদ লোকেরাই সে ব্যতিক্রমের সুবিধা চেটেপুটে ভোগ করবে। মুখে নিয়মকে গাল দেওয়া লোকগুলোই নিয়ম ভেঙে, দুমড়ে বা মুচড়ে নিজেদের সুবিধাতে ব্যবহার করবে। যেখানে যত নিয়মের কড়াকড়ি বা বাড়াবাড়ি সেখানে তত বদ লোকের আনাগোনা। পাশপোর্ট অফিস, আদালত চত্বর, রোড ট্রান্সপোর্ট অফিস, রেলের টিকিট রিজার্ভেশন অফিস, জমির রেজিস্ট্রেশন বা মিউটেশন অফিস সর্বত্রই এই ধরণের বদ লোকের বিচরণ ক্ষেত্র। বাড়ির সংসারেও নিয়ম মানার নিয়ম আলাদা কিছু নয়। আগেকার দিনে একান্নবর্তী পরিবারে একজন কর্তা থাকত। তার তৈরি করা নিয়ম কানুন সবাই মেনে চলত। সংসার একটা গন্ডিতে আবদ্ধ থাকত ঠিকই তবে সে গন্ডি ছিল শৃঙ্খলারক্ষার গন্ডি, সংসারকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার গন্ডি। সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটত ভালবাসার গাম্ভীর্যে। জেঠা সংসারের কর্তা হলে তার নিয়মকে ওভাররুল করার ক্ষমতা দাদু বা ঠাকুমা ছাড়া কারোর ছিল না। এখন সে গন্ডি ভেঙে গেছে। ছোট ছোট সংসারে সবাই নিয়মের স্রষ্টা। পালনকর্তা কেউই নয়। "আমরা সবাই রাজা" র অপব্যাখ্যা। সেই পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে নিয়ম পালন করবে বা করাবে কে? যারা বাড়িতে আবেগ আর ভালবাসার সুযোগ নিয়ে নিয়মের থেকে নিয়মের ব্যতিক্রমকে বেশি করে কার্যকরী হতে দেখেছে তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রেও তাই করবে। এটাই স্বাভাবিক। তাই, একই কাজের ক্ষেত্রে এক একজনের জন্য এক এক রকম নিয়ম হতেই পারে। নিয়ম তখন এত "ফ্লেক্সিবল" হয়ে যাবে যে তার এপ্লিকেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ, খুবই সাধারণ মানুষের জন্য এই ফ্লেক্সিবিলিটি যদি থাকত তাহলে হয়ত সবাই নিয়মকে শ্রদ্ধা করত। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে পারে। এক বৃদ্ধা, যার সিঁড়ি দিয়ে বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ওঠার ক্ষমতাই নেই তাকে যদি তিনতলার কোন সরকারি অফিস কোন ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনের জন্য সশরীরে ওপরে যেতে বলে তাহলে নিয়মের গেরোয় সেই বৃদ্ধার প্রাণ যাবেই যাবে। নিয়মে আছে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন প্রয়োজন। সুতরাং বৃদ্ধাকে ওপরে যেতে হবে। কেন? যে ভেরিফিকেশন করবে সে বৃদ্ধার কাছে নীচে এলে কি ক্ষতি? বৃদ্ধার পিছনে সাপোর্ট দেওয়ার কেউ নেই, সুতরাং টাইট নিয়ম আছে। এখন শুনছি, অনেক ক্ষেত্রে এমন নিয়ম চালু হয়েছে। অর্থাৎ, নিয়মের প্রয়োজনে অফিস যাবে কাস্টমারের কাছে। খুব ভাল কথা। যান্ত্রিক সমাজে যদি এমন অযান্ত্রিক, সাহায্যকারী, মানবিক মুখের নিয়ম চালু হয় তাহলে নিশ্চয়ই তাকে স্বাগত। আমার যখন একটু একটু করে জ্ঞানচক্ষু খুলছে তখন কাস্টমারের সংজ্ঞা জেনেছিলাম। "জো কস্ট সে মর জায়ে, ওহি কাস্টমার।" লাল ফিঁতের ফাঁস বা নিয়মের গেরো এই সংজ্ঞারই অংশ। মনে রাখতে হবে, নিয়ম আমরাই তৈরি করেছি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। যতদিন না, মানুষের প্রয়োজনকে আমরা অগ্রাধিকার দেবো, ততদিন নিয়মের গেরো থাকবে। স্বচ্ছ মানসিকতা নিয়ে মানুষের সাহায্য আর প্রয়োজনের কথা মাথায় রাখলে নিয়মের গেরো থাকবে না। সুফল থাকবে। আর ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থে নিয়ম ব্যবহার করলে তা মানব সমাজকে রসাতলে নিয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকা উচিত নয়।

news story feature literature poet realization bengali short story West Bengal গল্প বাংলা গল্প সাহিত্য নিখিল কুমার চক্রবর্তী

Last Updated : 4 years ago