header banner

উপলব্ধি: জেনারেশন গ্যাপ- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

একটা কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। "আমাদের সময় এমন ছিল না" বা "আমাদের সময়কার ছেলেমেয়েরা এমন ছিল না।" আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন শুনেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরাও শুনছে। আমাদের আগেকার সময়ে মানে, আমাদের বাবা কাকা বা মা মাসীদের সময়েও তারা শুনেছে। অর্থাৎ ছোটদের সবসময় বড়দের কাছ থেকে এই সব কথাগুলো শুনতে হয়েছে। আমি যখন সবে একটু উড়তে শিখেছি তখন বন্ধুদের সাথে এক হিন্দী সিনেমা দেখে ফেরার পর আমার এক জামাইবাবু বলেছিলেন, "কি যে তোরা হিন্দী সিনেমাগুলো (তখন আমরা হিন্দী সিনেমা, বাংলা সিনেমা ইত্যাদি বলতাম। হিন্দী বা বাংলা মুভি বলার চল তখন ছিল না) দেখিস, এতে কি পাস? সেই তো হেলেনের নাচ আর ভিলেনের ঢিসুম ঢিসুম। জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চলে আসছে।" তখন মনে কোন প্রশ্ন জাগে নি। জামাইবাবুর কথাগুলো সত্যি মনে হয়েছিল। চোখের সামনে সিনেমার পর্দায় তা দেখতাম যে! কিন্তু আজ সেই জামাইবাবু বেঁচে থাকলে বলতাম, "না জামাইবাবু, এখন হেলেনকে আলাদা করে নাচার জন্য রাখতে হয় না বা ভিলেনই শুধু ঢিসুম ঢিসুম করে না। এখন নায়িকা, তার মা, বান্ধবী সবাই নাচে আর ভিলেন, নায়ক, তাদের বন্ধু বান্ধব সবাই ঢিসুম ঢিসুম করে। এমন কি ঢিসুম ঢিসুম ছাড়াই মহিলা ভিলেনগিরি হয়।" তাহলে কি দাঁড়াল? জেনারেশনের পর জেনারেশনে একই প্রবাহ চলে না। সবকিছুই পাল্টায়। আমরা হোয়াটসঅ্যাপ কি জিনিষ ছোটবেলায় জানতাম না। খাম, ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড জানতাম। পড়াশোনা মানে বই, খাতা, পেন, পেনসিল জানতাম। ইন্টারনেট, অনলাইন ক্লাস, মক টেস্ট জানতাম না। এখন জানছি, জেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা এতেই অভ্যস্ত। সুতরাং তারা প্রথম থেকেই অনেকটা এগিয়ে। আমরা মোবাইল ফোন কি জিনিষ ছোটবেলায় জানতাম না। সময় এগোনোর সাথে সাথে ল্যান্ডফোন দেখেছি, পরে মোবাইল ফোন। এখনকার ছেলেমেয়েরা জন্মের পর থেকেই মোবাইল ফোন দেখছে। হাতের মুঠোয় তাদের পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। যোগাযোগ, টাকাপয়সার লেনদেন, পড়াশোনা সবকিছুই অনায়াসে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে। অনেককিছু তাদের জানা। বড়দের অস্বস্তিতে ফেলে তারা অনায়াসে মানবের বায়োলজিক্যাল নিডস নিয়ে আলোচনা করতে পারে। কোন কোম্পানি ভাল বা খারাপ চটজলদি জবাব দিতে পারে। কারণ সত্যিই জানে তারা। আর বড়রা কি করে? "জেনারেশন গ্যাপ" এর দোহাই দিয়ে তাদের "পিছনপাকা" "সবজান্তা" অাখ্যা দেয়। আচ্ছা বলুন তো, কোন দুঃখে তারা পরিশ্রম করে খাটাখাটি করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে নোট টুকে আনবে বা পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করবে? বেশি দূরে প্রাইভেট পড়তেই যাবেই বা কেন? এখন এর জন্য যদি আমরা তাদের শ্রমবিমুখ বলি তাহলে কি ঠিক বলব? আমরাও তো অনেককিছুর সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছি। তাহলে আমরাও কি শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ছি? কোনকিছু নিজেদের মনের মত না হলেই তাকে "জেনারেশন গ্যাপ" এর তকমা দেওয়া কি ঠিক? এখন করোনার প্রভাবে আমাদের লাইফ স্টাইল, ওয়ার্কিং স্টাইল সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। গৃহস্থের বাড়িতে যেখানে মিনিমাম একটা কাজের লোক না থাকলে চলত না সেখানে করোনা ছড়ানোর ভয়ে সব কাজ বাড়ির লোকেদেরই করতে হচ্ছে। ঘর মোছা, বাসন মাজা, কাপড়কাচা সব। যারা সবসময় বাইরে শপিং মল, মার্কেট কমপ্লেক্সে উইনডো শপিং করে বেড়াত তারাও গৃহবন্দী থাকতে বাধ্য হচ্ছে। অফিস লকডাউনে বন্ধ থাকায় ই-অফিসের মাধ্যমে বাড়িতে বসে কাজ করতে হচ্ছে। বাড়িতে বসেই ভিডিও কনফারেন্সে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করতে হচ্ছে। কেউ ভেবেছিল এমনভাবে কখনও চলতে হবে? তাহলে এটাকেও জেনারেশন গ্যাপ বলব আমরা? আসলে সময় আর পরিস্থিতির বিচারে নিজেদের পাল্টে নেওয়ার নাম ই জীবন। প্রতিকূলতার মধ্যে আত্মপ্রকাশ আর বিকাশের নামই জীবন। একে আলাদা করে জেনারেশন গ্যাপ নাম দিয়ে জেনারেশনের ধারক আর বাহকদের দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। তবে একটা কথা ঠিক। ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পাঠ পড়ানোর দায়িত্ব বাড়ির বড়দের। তা না করে শুধুমাত্র সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছোটার পাঠ পড়ালে বাচ্চা পিছলে পড়বেই। আগেই বলেছি এখন ওদের হাতের মুঠোয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। তারা অনেককিছুই বেশি জানবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু সেই জানার মধ্যে যেন অহংকার ফুটে না বেরোয়, পারিপার্শ্বিক মানুষজনের প্রতি অবজ্ঞা যেন প্রকাশ না পায়! যদি পায় তাহলে ব্যর্থ হয়ে যাবে শিক্ষা, ব্যর্থ হয়ে যাবে সংস্কৃতির পাঠ। জেনারেশন গ্যাপের বুলি আউড়ে এড়িয়ে গেলে চলবে না। যারা সমাজের প্রগতির হোতা তাদের বিশেষ করে এটা মাথায় রাখা দরকার। ডাক্তার যদি রোগী ভাল হবে না ধরে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করে তাহলে ডাক্তারের ভূমিকাই তো গৌণ হয়ে যায়! তাই না? শুধু নিয়ম তৈরি করে যেমন নেতা, প্রশাসকের দায়িত্ব শেষ হয় না, তেমনি শুধু একটা জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের দোষ দিয়ে জেনারেশনকে ভাল করা যায় না। তাদের মানসিকতা উন্নত করার জন্য পরিবেশ আর শিক্ষাকেও সময়োপযোগী করতে হয়। আর কে না জানে, "চ্যারিটি বিগিনস্ এট হোম"! সুতরাং বাচ্চার মানসিকতা গঠনে প্রাথমিক পাঠ পড়াতে হবে বাড়ির লোকজন আর পরিবেশকেই। এটা এড়িয়ে কোন সুস্থ মানসিকতা গঠন করা যায় নি কখনও, এখনও যাবে না।

{ads}

news literature short story bengali short story story Generation Gap feature West Bengal India গল্প ছোটগল্প প্রবন্ধ

Last Updated :