header banner

উপলব্ধিঃ গাঁইয়া- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

গুগল জেঠু জানাচ্ছে "গাঁইয়া" শব্দের অর্থ "অমার্জিত রুচি","অভব্য" ও হয়। দেখে চমকে উঠলাম। আমি তো নিজেকে গাঁইয়া বলতে ভালবাসি। মানে, নিজেকে গ্রাম্য বলতে খুব পছন্দ আমার। হবে নাই বা কেন? আদতে তো গ্রামেরই লোক। তা স্বীকার করতে আপত্তি কেন থাকবে? পেশার সূত্রে বা নেশার দরুণ মফস্বল, শহর বা নগর যেখানেই ঘুরে বেড়াই বা সাময়িক ভাবে থিতু হই না কেন, গা থেকে গাঁয়ের ছাপ মুছি কি করে? অবশ্য নিজেকে অমার্জিত রুচির বা অভব্য মানতে আমার একশ শতাংশ আপত্তি আছে। "গ্রাম্য" অর্থে আমি নিঃসন্দেহে "গাঁইয়া"। আমার অনেক স্বনামধন্য বন্ধুর কাছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এরজন্য আমাকে বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে। কলকাতার অনেক কিছু চিনি না বলে হাসি ঠাট্টা সহ্য করতে হয়েছে। যেন পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধুই কলকাতা। এই মানচিত্রে হাটগোবিন্দপুর, বাদলকোনা, পাড়াতল, গাংপুর, দামিন্যা, তৈলাড়া, পলেমপুর, মানকর, পুরশো, মাড়ো ইত্যাদির কোন স্থানই নেই। এখানে শুধু ধর্মতলা, বিবাদীবাগ, তালতলা, রবীন্দ্রসদন ইত্যাদিরই অধিকার। এই মানচিত্রে বর্তমানে গড়িয়া, বেহালা, পাটুলি, নিউটাউন, রাজারহাট ইত্যাদিও যুক্ত হয়েছে। যাই হোক, বন্ধুর কথায় আসি। একদিন কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে হাবিবের সেলুনের কথা বলেছিল এবং জিজ্ঞাসা করেছিল আমি হাবিবে যাই কি না! আমি না বলাতে সে কলকাতার আরও কিছু প্রসিদ্ধ ফ্যাশন শপ, রেস্তোরাঁ, মল ইত্যাদির নাম বলে সেগুলোর স্থান বা ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি সত্যিই জানতাম না। আমার সেই বন্ধু(?) বিচিত্র ভঙ্গীর ব্যঙ্গার্থক হাসি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল এগুলো না জানা চরম অন্যায়। আমি সহাস্যে তার কথা মেনে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম সে "উৎসব ময়দান", "বাঁকা নদী", "মোহন্ত অস্থল" চেনে কিনা? যথারীতি সে চেনে না এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল এই জায়গাগুলো কোথায়! আমি জানিয়েছিলাম, এগুলো সব বর্ধমানে। সে হেসে বলেছিল "বর্ধমানের জায়গা আমি জানব কেমন করে?" আমি খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম, "মানে, পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক কিছু আছে যা তুমি জান না। শুধু কলকাতাকে জানলেই বাংলাকে জানা হয় না। আর না জানার মধ্যে যদি লজ্জা জড়িয়ে থাকে তাহলে তোমারও লজ্জিত হওয়া উচিত।" বলা বাহুল্য আমার কথা তার ভাল লাগে নি এবং নিজে প্রত্যন্ত জায়গা থেকে কলকাতায় উঠে আসা এই বন্ধুটি অনেককেই গাঁইয়া বলা থেকে বিরত হয়নি। যদিও গুগল জেঠুর কথা সত্যি হলে আমার ঐ বন্ধুটির ব্যবহার আমার মতে অমার্জিত রুচি সম্পন্ন। আর তাকেই সবার আগে গাঁইয়া বলা উচিত। একটা কথা আমার খুব কম "গ্রে ম্যাটার" সম্পন্ন মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। এই যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাউকে না কাউকে গাঁইয়ার তকমা লাগিয়ে দিয়ে ব্রাত্য করে রাখার চেষ্টা করা হয় তা কি শুধুমাত্র কাউকে অপদস্থ করার জন্যই? না কি নিজেকে তার সমকক্ষ করে তোলার প্রচেষ্টায় হেরে গিয়ে ঈর্ষাজনিত কারণে তাকে ছোট করার আপ্রাণ প্রয়াস? এখন গ্রাম বা মফস্বল থেকে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রথম হওয়া বা প্রশাসকের ভূমিকা নেওয়া ছেলে মেয়ের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। এই ধরণের গাঁইয়ারা দেশের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীনও হচ্ছে। দেশ বা বড় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সামলাচ্ছে। তথাকথিত শহুরেদের পক্ষে এটা একটা বিপদসংকেত নিঃসন্দেহে। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যেখানে একসাথে অনেক শহুরে আর গাঁইয়া মিলেমিশে বিচরণ করে সেখানে কোন অঘটন ঘটলে সবার আগে সন্দেহের তীর তথাকথিত গাঁইয়াদের দিকেই এগিয়ে যায়। যেন বাকি সবাই সন্দেহাতীতভাবে সন্দেহের পরিধির বাইরে। আবার এই গাঁইয়ারাই যখন সাফল্য নিয়ে আসে তখন শহর তাদের কিভাবে বা কতটা সাহায্য করেছে তা ফলাও করে বিজ্ঞাপিত হয়। এই জন্যই আমাদের "দঙ্গল", "চক দে ইন্ডিয়া" বা "কণি"র মত সিনেমা তৈরি করতে হয়। আরো অনেক সিনেমার নাম বলা যায় বা গ্রন্থের উল্লেখ করা যায়, যেখানে আমরা দেখতে পাই গ্রাম থেকে উঠে আসা কোন ছেলে বা মেয়ে নিজের গুণে সবার মন জয় করে নিয়েছে। কোন বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। এখান থেকে কি আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পারি? শিক্ষাটা এই যে, "জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল।" প্রশ্নটা "গাঁইয়া" বা "শহুরে" তে সীমাবদ্ধ নয়, প্রশ্নটা আটকে আছে মানসিকতায়, শিষ্টাচারে আর সর্বোপরি মূল্যবোধে। এগুলো না থাকলে কেউ যেমন মার্জিত রুচি সম্পন্ন হতে পারে না, তেমনি কোন মানবসমাজও উন্নত হতে পারে না। মূল্যবোধের অবক্ষয় মানে এক সামগ্রিক অবক্ষয়। এটা যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝব ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।

{ads}

news literature village Indian village realization short story bengali short story Nikhil kumar Chakrabarty সাহিত্য ছোটগল্প সংবাদ গল্প

Last Updated :