ব্রিটিশরা মোটামুটি দুশো বছরের মত আমাদের মাথায় চেপে বসেছিল। তাতে যা হওয়ার তা হয়েছে। এত বছর ধরে মাথার ওপর এমন ভারী বোঝা চাপানো থাকলে শিরদাঁড়া বেঁকে যেতে বাধ্য। গেছেও। বেঁকে গিয়ে এমন অবস্থা যে আর মাথা উঁচু করার কোন উপায়ই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, মানসিক পরিবর্তনও ঘটে গেছে। অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে ভীষণরকম। দুশো বছর মাথায় ইংরেজরা চেপে থাকলে যা হয় আর কি! ইংরাজি না বললে, ইংরেজদের পোষাক না পরলে নিজেকে যেন ভদ্রদুরস্ত বলে প্রমাণ দেওয়া যায় না। দুজন বাঙালি বা দুজন পাঞ্জাবি অথবা দুজন মাড়োয়াড়িও নিজেদের মধ্যে ইংরাজিতে কথা বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। যত দিন যাচ্ছে তত অভ্যাস খারাপ হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব পোষাক ধূতি পাঞ্জাবি বা শাড়ি এখন উৎসবের পোষাক। অবশ্য এটা মেনে নেওয়া ভাল যে, আজকের জেট যুগে ধূতি পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরে রাস্তাঘাটে বেরুনোটা বিপজ্জনক। সেই হিসাবে উৎসবে ব্যবহার হলেও অন্তত কিছুটা মর্যাদা দেওয়া হয় নিশ্চয়ই। অনেকবছর আগে যখন আমি কলকাতায় থাকতাম না, তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমার এক সিনিয়র সহকর্মী দাদার সাথে বিশেষ প্রয়োজনে কলকাতায় এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে একাউন্ট ওপেন করতে এসেছি। বর্ধমানের এড্রেস দেখে প্রথমেই ওখানে একটু নাক সিঁটকিয়ে জানানো হল, বাড়ির ঠিকানায় একটা রেজিস্ট্রি চিঠি যাবে। সেটা নিয়ে এসে দেখালে তবেই চেকবুক, পাশবুক দেওয়া হবে। সন্তুষ্ট হয়ে চলে এলাম। ওমা, দু তিন মাস পরেও চিঠি আসে না। একাউন্টার আমার খুব প্রয়োজন ছিল। অথচ কাজ হচ্ছে না। যতবার কলকাতায় গিয়ে খোঁজ করি ততবারই শুনি এক কথা। চিঠিটা আনতে হবে। ওটাই না কি এড্রেস ভেরিফিকেশন। তখন এত মুঠোফোনের চল ছিল না। ল্যান্ডফোনও কতিপয় লোকের বাড়িতে শোভাবর্ধক উপাচার হিসাবে থাকত। সুতরাং, কলকাতায় গিয়ে বারবার খোঁজখবর নিতে হত। বারবার কলকাতা গিয়ে বিরক্ত হয়ে একদিন বলেই ফেললাম, "এড্রেস ভেরিফিকেশন করতে হয় তো লোক পাঠান। এত মাস ধরে চিঠি পাঠিয়ে বসে আছেন কেন?" বেশ ধমক খেতে হল। শুনলাম, "নিশ্চয়ই আপনার এড্রেসে গণ্ডগোল আছে, না হলে চিঠি পাচ্ছেন না কেন?" অপমানিত বোধ করলাম। শেষে কিনা আমার ঠিকানা ঠিক নয়? খুব ঝামেলায় পড়লাম তো! সেই সহকর্মী দাদাকে বললাম। উনি সব শুনে বললেন, "বাংলায় কথা বললে কেউ শুনবে না। ওখানে গিয়ে ইংরিজিতে কথা বল। তার আগে নিজের প্যাডে ইংরিজিতে লিখে একটা ঝেড়ে কমপ্লেন কর। লিখবি যে ওদের ব্যবহারে তুই অপমানিত বোধ করছিস।" তাই করলাম। পরিস্কার জানালাম, "তোমাদের সিস্টেমের জন্য একজন ভ্যালুয়েবল কাস্টমার কেন সাফারার হবে? এড্রেস ভেরিফিকেশন করতে হলে লোক পাঠাও। যদি তোমরা এইভাবে আমাকে আরও হেনস্থা কর, তাহলে আমি লিগ্যাল একশন নোব।" এর সপ্তাহ দেড়েক পরে ব্যাঙ্কে দেখা করতে গেলাম। সেখানে কি হল তা আর ব্যক্ত করলাম না। ম্যাক্সিমাম মিনিট দশেক সময়ের মধ্যে সমস্ত কিছু আমার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ম্যানেজার তার চেম্বারে বসিয়ে চা খাইয়ে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়েছিলেন। হ্যাঁ, সহকর্মী দাদার কথা অনুযায়ী আমি ওখানে আমার ক্ষমতা অনুযায়ী যথাসম্ভব ইংরাজিতেই কথা বলেছিলাম। ওনার কাছেই শেখা, কোথাও কাজের জন্য গিয়ে "এক্সকিউজ মি" বলে শুরু করলে এটেনশন বেশি পাওয়া যায়। জীবনে এই উপদেশ পালন করে যে উপকৃত হইনি তা জোর দিয়ে বলতে পারব না। আমি সবসময় "সুপ্রভাত", "শুভরাত্রি" এইভাবে বলতে ভালবাসি। এরজন্য যেমন আমার আলাদা পরিচয় তৈরি হয়েছে তেমনি লোকের বিরাগভাজনও হয়েছি বৈ কি! ফোন তুলে "সুপ্রভাত" বললেই অপর প্রান্তের মানুষটি বুঝে যেত এ প্রান্ত থেকে কে কথা বলছে। আবার অনেকে "বাঙালি প্রেমিক" তকমা দিয়ে অনেক বিরুদ্ধতাও করেছে। এই সংকীর্ণ মানসিকতাই আমাদের অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। ইংরাজি ভাষাকে অবজ্ঞা বা অস্বীকার করার কোন উপায় আমাদের নেই। এত ব্যাপক এবং বিশাল পরিধি নিয়ে বিস্তৃত থাকা এই ভাষার গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। কিন্তু তার জন্য অপ্রয়োজনে নিজের ভাষাকে পরিহার করতে হবে কেন? কেন অন্য ভাষাকে ব্রাত্য করে দিতে হবে? ছোট ভাবতে হবে? মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই যদি ভাষা হয়, তাহলে অনাবশ্যকভাবে মাতৃভাষা ছেড়ে অন্যভাষা ব্যবহার করার মধ্যে কি মাধুর্য থাকতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়। এখনকার ছেলেমেয়েরা বাংলা, ইংরাজি, হিন্দি মিলিয়ে অদ্ভূত এক ভাষা ব্যবহার করে। তারা এতেই সাবলীল। আমরা যদি তা মেনে নিতে না পারি তাহলে হয়ত খামতি টা আমাদের মধ্যেই রয়ে গেছে। ওরা তো আর ব্রিটিশের গোলামি করেনি। তাহলে? এটা বোধহয় অতি আধুনিকতার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আমাদের মত প্রাচীনপন্থীদের মাথায় ঢুকবে না। এতে ভাল হবে না মন্দ হবে তা সময়ই বলে দেবে।