বেশ কিছুদিন বা বেশ কিছুক্ষণ পরে বাইরে থেকে ঘুরে আসার পর বাথরুমে ঢুকে বাথরুমের মেঝেটা শুকনো খটখটে দেখলে বেশ আনন্দ হয়। এমনিতে বাথরুমের মেঝে সবসময় ভিজেই থাকে। জলে ভিজে থাকার কারণে হাল্কা শ্যাওলা জমে কখনও সখনও। শুকনো দেখার পর প্রথমে বিশ্বাস হয় না। চারদিক পা বুলিয়ে দেখে নিই, সত্যি সত্যিই শুকনো তো? নিশ্চিন্ত হওয়ার পর সারা মনে একটা প্রশান্তির, একটা সুখানুভূতির শিহরণ বয়ে যায়। কেন এমন হয়? বাবা বলতেন, "ঠাকুর বলেছেন রাজহংসের মত হও। দুধ আর জল মেশানো থাকলে সেখান থেকে দুধটুকু আলাদা করে নিতে শেখ।" তখন এত তত্ত্বকথা বুঝতাম না। মনে হত, এটা আবার হয় না কি? দুধ আর জল মেশানো থাকলে দুধকে আলাদা করা সম্ভব না কি? সত্যিই কি রাজহাঁস তা পারে? পরখ করে দেখি নি কোনদিন। বাবার কথাই সার কথা। তিনি তো জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন! সুতরাং মেনে নিয়েছি। আজ এই জীবন সায়াহ্নে এসে বুঝি, বাবা কত খাঁটি কথা বলতেন। সমাজের প্রতিটা স্তরে দুধ আর জল এক হয়ে মিশে আছে। সেখান থেকে দুধকে আলাদা করাটাই কঠিন। তবে, তা করতে পারলে জীবন নিশ্চয়ই শান্তির হবে। সুখের হবে কি না, তা জানি না। কারণ, সুখ কথাটাই আপেক্ষিক! কার যে কিসে সুখ আসে তা হয়ত সে নিজেই জানে না। কেউ দুধ বেচে মদ খেয়ে সুখের স্বাদ পায় তো কেউ মদ বেচে দুধ খেয়ে। এই যে বাথরুম শুকনো দেখে আনন্দ পাওয়া, এটাও তো সেই একই পর্যায়ের কথা। যা দেখতে অভ্যস্ত আমরা, তার থেকে আলাদা কিছু দেখে আনন্দ পাওয়া। কোথাও একটা কার্টুন দেখেছিলাম, বেতাল, অরণ্যদেব, শক্তিমান এবং এক সৎ রাজনীতিবিদের ছবি এঁকে বলা হয়েছিল এগুলোর মধ্যে একমাত্র সৎ রাজনীতিবিদই বাস্তবে সম্ভব নয়, বাকিগুলো বাস্তবে থাকলেও থাকতে পারে। তাই কোন রাজনীতিবিদ সৎভাবে সমাজের সেবা করার জন্য সামনে এলে তাঁকে মানুষ হৃদয়ে আসন দেয়। তাঁর সান্নিধ্যে আনন্দ পায়। এখনকার প্রজন্ম সাধারণত মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয় না। তারা কেরিয়ারের ভ্যালু বোঝে, চাকরির ভ্যালু বোঝে কিন্তু মূল্যবোধ বোঝে না। আমরাই তাদের বুঝতে শেখাই নি। ছোট্টবেলা থেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে শিখিয়েছি। দু আড়াই বছর বয়স থেকে পিঠে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে কেরিয়ার সচেতন হতে শিখিয়েছি, দাদু দিদিমা ঠাকুমা মামা মাসী পিসির সম্পর্ক না বুঝিয়ে শুধুমাত্র ড্যাড মমে আবদ্ধ থাকতে শিখিয়েছি। অর্থাৎ বাড়ির বাগানে যত্ন করে বাবলাগাছ বসিয়েছি। সেই গাছে মিষ্টি আর রসাল আম ফলবে কি করে? তারই মধ্যে যদি কেউ যত্ন করে সত্যি সত্যিই মিষ্টি আর রসাল আম গাছ বসায় এবং সেরকম ফল পায় তাহলে তা সেই শুকনো খটখটে বাথরুমের মেঝের মতই হবে। তাই না? সমাজের প্রতিটা মেঝেতে জল জমতে জমতে যে শ্যাওলা পড়ে গেছে তা তুলে ফেলার জন্য প্রকৃত ব্লিচিং পাউডার প্রয়োজন। ব্যতিক্রম কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। না থাকলে এই জগত সংসার চলছে কি করে? তবে, ব্যতিক্রম নিয়মের অস্তিত্বকেই প্রমাণ করে। যে কোন খারাপ নিয়মের ভাল ব্যতিক্রম থাকতে পারে আবার ভাল নিয়মের খারাপ ব্যতিক্রম থাকতে পারে। প্রথমের থেকে দ্বিতীয়টাই কাম্য হওয়া উচিত। তা হচ্ছে না বলেই চারদিকে বিশৃঙ্খলা! তবে ভাল মন্দে মেশানো জীবন শুধুমাত্র ব্যতিক্রমে আবদ্ধ থাকতে পারে না। অভিজ্ঞতার নিরিখে ভালকে ভাল বলে বা খারাপকে খারাপ বলে চিনতে পারাটাই আসল। যতদিন না সে শিক্ষা আমাদের হচ্ছে ততদিন বাথরুম শুকনো হবে না। শ্যাওলা জমে থাকবে মেঝেতে। হড়কে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে। অর্থাৎ, সমাজে বা জীবনে শিক্ষা প্রতিফলিত হবে না। আমরা নচিকেতার গলায় "যে মেয়েটা রোজ রাতে বদলায় হাতে হাতে তার অভিশাপ নিয়ে চলাই জীবন" বা "প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা আমাদের স্বপ্ন আমাদের চেতনা" গানে হাততালি দিয়ে আত্মরতিতে মগ্ন হই কিন্তু যে শ্যাওলার দিকে তিনি আঙ্গুল তুলেছেন তা পরিষ্কার করতে সচেষ্ট হই না। এ এক অন্য ধ্বংসলীলা, অন্য রতির খেলা। উত্তর আমাদেরই খুঁজতে হবে। কারণ বাথরুমটা আমাদের নিজেদের! এখানেই স্নান করে আমরা স্নিগ্ধ, শান্ত হই।
{ads}