কতদিন পরে সুমিতের মুখোমুখি হলো নিশা, মনে করতে পারছে না। মানে, ঠিক এইভাবে দুজনে যেন কিছু জবাবদিহির জন্য তৈরি ছিল অনেকদিন থেকে। যোগাযোগটা ঠিকমত হচ্ছিল না। তবে মুখোমুখি হওয়াটা জরুরী ছিল। অন্য সময়ে নিশাই লিডিং রোল নেয়। আজও তাই চলছিল। কিন্তু রাগ দেখিয়ে নিশার চলে যাওয়ার মুখে হঠাৎ করে সুমিত প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠল
---দাঁড়া। এভাবে আমার সব কথা না শুনে চলে গেলে হবে না। এতদিন আমি কোন কথা বলিনি। অনেকবার আমার বিরুদ্ধে কারণে, অকারণে অনেক অভিযোগ তুই তুলেছিস। আমি কোন প্রতিবাদ করিনি। তোর কথা চুপ করে শুনে গেছি। অপেক্ষা করেছি। ভেবেছি তুই ঠিক বুঝে নিতে পারবি আমাকে। ঠিক অনুভব করতে পারবি সবকিছু। চিরকাল যেমন তোর ওপর ভরসা করেছি তেমনই ভরসা করেছি আজ পর্যন্ত। কিন্তু তুই যখন এখনও বুঝতে চাইছিস না আমাকে, তখন তোকে কিছু বলতেই হয়। আজ আমার কথা তোকে শুনতেই হবে। বোস চুপ করে। একটাও কথা বলবি না।
একটানা কথাগুলো বলে একটু থামল সুমিত। একসাথে এত কথা বলা তার অভ্যাসে নেই। বলার থেকে শুনতেই বেশি ভালবাসে। বন্ধু মহলে নির্বাক শ্রোতা হিসাবে তার সুনাম আছে। বলার থেকে শুনতেই সে অভ্যস্ত বেশি। বিশেষ করে নিশার সাথে তার সম্পর্কে সে অনেকাংশেই অনুসরণকারী হিসাবে চিহ্ণিত। এটা সর্বজনবিদিত। আজ এতগুলো কথা সুমিতের কাছে একটানা শুনে নিশাও অবাক। হতভম্ব হয়ে গেছে। বুঝতে পারেনি সুমিত এতগুলো কথা একসাথে বলবে। একপ্রকার অবাক হয়েই সুমিতের ঘরের কোনের সোফা সেটটায় বসে পড়ল।
-- তুই অবাক করে দিলি আমাকে। এত কথা তুই বলতে পারিস? এখানে এসে তোর উন্নতি হয়েছে তো বেশ! ঠিক আছে, কি বলতে চাস, বল শুনি।
সুমিত আর নিশার মধ্যে সম্পর্ক আজকের নয়। সেই স্কুল জীবন থেকে। এক পাড়াতে থাকলেও তাদের বাড়ি খুব কাছাকাছি নয়। বলা যায়, পাড়ার দু প্রান্তে দুটো সম্পূর্ণ মডার্ণ ডিজাইনের বাড়ি। পাড়ার শুরুতে সুমিতদের আর শেষ প্রান্তে নিশাদের। খুব ছোটবেলা থেকেই ওরা দুজনে একসাথে বড় হয়েছে। বাড়ি একটু দূরে হলেও দুটো বাড়ির মধ্যেও সম্পর্ক বেশ ভাল। সুমিতের বাবা মা দুজনেই চাকরিজীবী। বাবা কলেজের অধ্যাপক আর মা স্কুল শিক্ষিকা। নিশার বাবা কলকাতার বিখ্যাত বস্ত্র ব্যবসায়ী। মা গৃহবধূ। প্রকৃতপক্ষে তারা গুজরাটী। কিন্তু নিশার ঠাকুরদার কলকাতায় ব্যবসা করতে আসার সুবাদে তারা এখন পুরোপুরি বাঙালী কালচারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিশার বাবা আর সুমিতের বাবাও সেই স্কুল জীবন থেকে একসাথে বড় হয়েছে। একজনের আনন্দ, দুঃখ সবসময় অন্যজন ভাগ করে নিয়েছে। বর্তমানে দুটোই প্রতিষ্ঠিত পরিবার। টিপিক্যাল ওয়ান চাইল্ড ফ্যামিলির নিদর্শন। স্কুলবাসে করে যখন সুমিত আর নিশা একসাথে স্কুলে যেত তখন থেকেই বস্তুত সুমিতকে নিশা গার্ড করত। সুমিত পড়াশোনায় তুখোড় হলে কি হবে, স্বভাবে ভীতু আর স্বল্পবাক। গোলগাল সুমিত সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালবাসত। ছিপছিপে নিশা ঠিক উল্টো। পড়াশোনায় সুমিতের মত তুখোড় না হলেও বেশ ভাল। প্রচণ্ড ছটফটে আর সাহসী। মুখে কথার ফোয়ারা ছোটে। কি করে বা কবে থেকে নিশা সুমিতকে গার্ড করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে তা ওরা নিজেরা কেন, কেউই বলতে পারবে না। সুমিতকে কেউ কিছু বললে প্রতিবাদের ঝড়টা নিশার দিক থেকে উঠত। সুমিত কিছু বলার আগেই নিশার বাক্যবাণ ছুটতে আরম্ভ করত। কখনও কখনও নিশার হাতও চলত। প্রকৃতপক্ষে নিশার ভয়েই কেউ সুমিতকে ঘাঁটাতে সাহস করত না।
মাধ্যমিকে দুজনের রেজাল্ট প্রায় সমান। নিশা সুমিতের চেয়ে একটু কম নম্বর পেল ঠিকই কিন্তু দুজনেই সায়েন্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি শুরু করল। এক কলেজে দুজনেই। কলেজের পরে দুজনের বেশিরভাগ আলোচনাতে নিশাই বক্তা। সুমিত শ্রোতা। হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্টও মাধ্যমিকের মতই। তাতে ওদের মেলামেশা বা হাবভাবে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। যেমন ছিল তেমনই চলতে থাকল ওদের জীবন। এর পর পড়ার খাতিরে ওরা দুজন দুদিকে চলে গেল। সুমিত যথারীতি জয়েন্ট দিয়ে এম বি বি এস পড়তে কলকাতা মেডিকেল কলেজে এল। হস্টেলে থাকতে আরম্ভ করল। আর নিশা লেডি ব্রাবর্ণে ইংরাজী অনার্স। ও জয়েন্টও দিয়েছিল। যা রেজাল্ট করেছিল তাতে কলকাতার কোন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতেও পারত। কিন্তু না, ওকে অধ্যাপিকা হতেই হবে। অতএব ইংরাজী অনার্স।
সুমিত হস্টেলে থাকতে আরম্ভ করলেও নিশা তাকে রেহাই দিত না। দুজনেরই স্তাবকের সংখ্যা তখন কম ছিল না। নিশা সুন্দরী না হলেও আকর্ষণীয়া। ছিপছিপে দোহারা চেহারা আর স্মার্ট। সুমিতের মত অত ধবধবে ফর্সা নয় নিশা। সুমিতের একেবারে টিপিক্যাল ভাল ছেলে মার্কা চেহারা। একটু গোলগাল, উচ্চতায় নিশার প্রায় সমান। অর্থাৎ, সাধারণ বাঙালী মেয়েদের তুলনায় নিশা একটু বেশি লম্বা। সুমিত হস্টেলে চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রায় রোজই নিশাকে তার কাছে আসতে হত। কিছু না কিছু অজুহাতে নিশা সুমিতকে ডেকে পাঠাত।
---একবার আয়, তোর রুমের জন্য একটা বেডশিট কিনতে হবে। নাহলে তো ঐ একটা বেডশিট নিয়েই হস্টেল লাইফ কাটিয়ে দিবি। নোংরা হলেও চোখে পড়বে না তোর। তোর মতো নোংরা লোক তো আর ভূভারতে কেউ নেই।
---এখুনি চলে আয়। আইনক্সে যাব। শিবপ্রসাদের নতুন মুভিটা দেখব। দেরি করবি না একদম। প্রথম থেকে দেখতে চাই।
--- আমার প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত কিছু জিনিষ কেনার আছে, মলে যাব। তোকে নিতে আসছি। তোর কি কিছু নেওয়ার আছে? লিস্ট করে রাখ।
---একজন আমাকে বড় জ্বালাচ্ছে, বুঝলি? আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে মনে হচ্ছে। মালটাকে নিয়ে তোর সাথে আলোচনা আছে। চলে আয় এখুনি। আমি তোর জন্য এমারজেন্সী গেটের কাছে ওয়েট করছি।
চলবে...
{ads}