নিশার মেসেজ পেয়ে হালকা হাসি খেলে গেল সুমিতের মুখে। 'দরকার' শব্দটা অন্যরকম একটা গন্ধ বয়ে নিয়ে এল। এখন আর কি দরকার থাকতে পারে? নিশার সম্বন্ধে অনেক খবরই সে শুনেছে অনিমেষ দত্তর কাছে। অনিমেষদা বাড়ি গেলেই নিজে আগ্রহ নিয়ে সুমিত ওদের কলেজের কথা জানতে চেয়েছে। ঘুরে ফিরে মোহন আর নিশার কথা জিজ্ঞাসা করেছে। প্রথম দিকে গুরুত্ব না দিলেও পরে অনিমেষ দত্তর মনেও সন্দেহ জেগেছে। জিজ্ঞাসা করেছেন
--কি ব্যাপার বলতো ভায়া? ওদের কথায় এত আগ্রহ কেন?
থতমত খেয়েছে সুমিত।
--না, না তেমন কিছু নয়। আপনিই তো বলছিলেন ওখানে চাকরি করতে গিয়েই দুজনের পরিচয়। তারপর কয়েক মাসের মধ্যে বিয়ে।
--তা বলেছি। তবে দুজনে একসাথে ওখানে চাকরি করতে আসেননি। মোহনবাবু ওখানে অনেক আগে থেকেই চাকরি করতেন। ভদ্রমহিলা পরে এসে জয়েন করেছেন।
--হ্যাঁ, সে তো আপনার কাছেই শুনেছি।
--যতটুকু জানি স্বভাবে দুজন ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। মোহনবাবু পড়ান ভাল, কথা বার্তায় মিষ্টভাষী ঠিকই, কিন্তু লোক ভাল নন। ভদ্রমহিলা খুবই স্মার্ট আর আপরাইট। সোজাসাপটা কথা বলেন। কি করে যে একজায়গায় জুটে গেল দুজনে। সে যাই হোক, তোমার আগ্রহ কাকে নিয়ে বলত ভায়া?
--দুজনকে নিয়েই।
সুমিত অনিমেষ দত্তকে আর এগোতে দেয় নি। বলতে পারেনি, নিশাই পারে এমন খামখেয়ালিপনা দেখাতে। ওর চেয়ে ভাল নিশাকে আর কে জানে!
নিশাকে ওর মেসেজের কোন জবাব দিল না সুমিত। কি জবাব দেবে? বরং তার মনে হয়েছে, নিশাকে বুঝিয়ে দেওয়া ভাল যে সুমিত ওকে ভুলতে চায়। নিশা নিজের পথ নিজেই বেছে নিয়েছে। সুমিতের সাথে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করে নি। সুমিতের কথা একবারের জন্যও ভাবেনি। সুমিত কেন এখন তার কথা ভাবতে যাবে? দিনের পর দিন নিশা যা বলেছে তাই করেছে। নিজের অস্তিত্ব, সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে নিশার সাথে থেকেছে। কোনদিন চিন্তাও করেনি নিশার থেকে আলাদা হয়ে জীবনধারণ করবে। তার পরিবর্তে কি দিয়েছে নিশা? এই বরং ভাল আছে। হাসপাতাল, রোগী, এন জি ও, জিম, অনিমেষদা ... সব মিলিয়ে সে মানিয়ে নিয়েছে এই জীবনকে। আর নতুন করে "নিশির ডাক" শোনার প্রয়োজন নেই। তবে ও নিশাকে যেটুকু চেনে তাতে ও জানত নিশা চুপ করে থাকবে না। চিরকালই ও নিজের দাবীতে অটল থেকেছে। নিজের প্রয়োজন মেটাতে ঝাঁপাবেই নিশা। আর সেটাতেই ভয় বেশি সুমিতের।
হলও তাই। তিনদিনের মাথায় অমোঘ বার্তা এল সুমিতের মোবাইলে। সকালে সবে হাসপাতাল যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মেসেজটা এল।
"আমি আজ বেলা বারটা নাগাদ আরামবাগ যাচ্ছি। নতুন জায়গা। কিছু চিনি জানি না। সোজা আারামবাগ হাসপাতালে চলে যাব। তুই থাকবি ওখানে।"
সুমিত নিজের ঘরের সোফাটায় বসে পড়ল। কি করবে এখন? প্রথমেই মাথায় এল অনিমেষদার কথা। তিনি নিশাকে ভালভাবেই চেনেন। সন্দেহ প্রকাশও করেছেন। ওকে এখানে দেখে কি ভাববেন কে জানে! সুমিত নিজেও জানেনা কেন আসছে নিশা। অনিমেষদাকে আগেভাগে সবকিছু বলে দেবে কি? কিন্তু নিশা আসছে কেন তাই তো জানে না সুমিত। পরে যদি এমন হয়, নিজস্ব ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারে সাজেশন নেওয়ার জন্য আসছে নিশা, এদিকে সে তার আর নিশার সম্পর্কের কথা ঢাক পিটিয়ে বলে রাখল অনিমেষদার কাছে তাহলে তো বেকায়দায় পড়ে যাবে সুমিত। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভাল। সিচুয়েশন বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াই ভাল। এবারেও কোন জবাব দিল না সুমিত। ও জানে, নিশা যখন আসবে ঠিক করেছে, আসবেই। ও জবাব দিক আর না দিক।
{link}
বারটা বাজার অনেক আগে থেকেই সুমিতের মনের মধ্যে আলোড়ন। মুখে যাই বলুক না কেন, কতদিন পরে নিশার সাথে দেখা হবে! নীরবে নিজের কাজ করে যাচ্ছিল ঠিকই তবে মাঝে মাঝেই ঘড়ির কাঁটার দিকেও লক্ষ্য রাখছিল। বারটা বাজতেই কাজের অজুহাতে ওয়ার্ডের বাইরে এসে হাসপাতালের মেন গেটটা পর্যন্ত ঘুরে গেল। গেটের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও রইল। না, নিশা আসে নি। বেলা দেড়টা বেজে যাওয়ার পরও নিশা এল না। সুমিত নিজেকে সান্ত্বনা দিল, এটাও নিশার খামখেয়ালিপনার আর এক নিদর্শন হবে। অপেক্ষা করে লাভ নেই। বাড়িতে গিয়ে লাঞ্চটা সেরে আসাই ভাল। সুমিত হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল।
নিজেই ড্রাইভ করে কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নিশা। প্রথমে ভেবেছিল পুল থেকে ড্রাইভার নেবে। পরে সিদ্ধান্ত বদল করল। আরামবাগে কতক্ষণ থাকবে সে নিজেও জানে না। সুমিত অনেক চেঞ্জড এখন। তার দেখা কখন পাবে, কতক্ষণ নিশাকে সে সময় দেবে কে জানে! তবে তাকে সব শুনতেই হবে। নিশার কথা সুমিত শুনবে না তা হতেই পারে না। নিশা শোনাবে তাকে। বাবা মা দুজনেই এত সকালে গাড়ি ড্রাইভ করে যাওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে জানতে চেয়েছিল। নিশা কিছুই জানায়নি। তাদের বারণও শোনেনি। মোহনকে বিয়ে করাটা বাবা মা ভালভাবে নেয়নি তা নিশা জানে। সম্পূর্ণভাবে নিজের জিদে সে বিয়ে করেছিল। কবে নিশা কারোর কথা শুনেছে! সে জানত সুমিত তার ওপর নির্ভর করে। তার কথাও একবার ভাবে নি সে। আজ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে এসব কথা তার খুব মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল সুমিতের আরামবাগ চলে যাওয়া, নিজেকে পাল্টে ফেলা, সবকিছুর জন্য সেই দায়ী। সুমিত কোনদিন তাকে ছেড়ে অন্য কারোর কথা চিন্তা করেনি, তার কথায় সবসময় সায় দিয়েছে। তাই কি সে সুমিতকে অবহেলা করার সাহস দেখাল? আগে থেকে যদি সুমিতের এখনকার রূপ দেখত নিশা, তাহলে হয়ত এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। খুব সহজে সুমিতকে পেয়ে গিয়েছিল বলেই তার মূল্য সে বোঝেনি। যে কোন প্রাপ্তি বোধহয় খুব সহজে না হওয়াই ভাল। অনায়াসলব্ধ যে কোন কিছুই মানুষ মূল্যহীন ভাবে। নিশা অনুভব করছিল, তার এই উপলব্ধি তাকে আর বেশি করে নিজের কাছে অপরাধী করে তুলছে।
{ads}