প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের পর
সুমিতের মায়ের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। সুমিত বাইরে গেলে প্রতি ঘন্টায় একবার করে ছেলেকে ফোন করে।
যাকে নিয়ে এত চিন্তা তাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। নির্বিকার আগের মতই। তবে তার ভেতরে ভেতরে একটা নির্মাণের কাজ হচ্ছিল। একটা জিদ, অদম্য জিদ তাকে আস্তে আস্তে স্বাবলম্বী হতে শেখাচ্ছিল। যতটা সম্ভব নিজের কাজ নিজে করে নেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল সে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হলেও ক্রমশ সব শিখে নিচ্ছিল সুমিত। নিজের জিনিষপত্র কেনা, ঘর গুছিয়ে রাখা, জামাকাপড় আয়রন করা, নিজের জন্য টুকটাক রান্না করে নেওয়া, সব শিখে নিচ্ছিল। বাড়ি থেকে মা বিয়ে করার তাগাদা দিলেও নিশ্চুপ থাকত সুমিত। নিশার বিয়ের পর নিশাকে কোন অভিযোগ জানায় নি। তার চরিত্রেই নেই এটা। নিজের বিয়ে নিয়েও কোনদিন ভেবেছে নাকি? বন্ধুরা তাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করত
--এতদিন তোকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলল তাহলে? আমরা যে নিশির ডাক বলতাম, তাহলে ঠিকই বলতাম। ঐ ডাকই তোকে ভুল পথে নিয়ে গেল।
সুমিতের এসব কথা ভাল লাগত না। উঠে চলে আসত বন্ধুদের কাছ থেকে। হস্টেলের চৌকিতে উপুড় হয়ে শুয়ে বুকের যন্ত্রণার উপশম খুঁজত। কাঁদতে পারলে হয়ত হালকা হত। তাও পারত না। নিশা তো তাকে কাঁদতে শেখায় নি!
সময় এগিয়ে চলতে থাকে। নিশার সাথে সুমিতের কথা কিছু হয় না বললেই চলে। সুমিত নিজের পি জি কমপ্লিট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলা ভাল, নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত করে রাখে। যথাসময়ে তার পি জিও কমপ্লিট হয়ে গেল। এরপরে কমপালসারি রুরাল সার্ভিস। সুমিত নিজে কলকাতা থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। কলকাতা থেকে মুক্তি পাওয়া তার খুব জরুরী। হন্যে হয়ে চেষ্টা করতে লাগল সুমিত। ব্যবস্থা হল। শুধুমাত্র বাড়িতে জানাল কোথায় যাচ্ছে। আর কাউকে না। বন্ধুদেরও না। নিশাকে জানানোর প্রশ্নই নেই। তার সাথে তো যোগাযোগই নেই।
আরামবাগের মহকুমা হাসপাতালটায় সুমিত যেদিন এসে জয়েন করল সেদিন আরামবাগের ছোট্ট শহরটায় তার মাথা গোঁজার ঠাঁই বলে কিছু ছিল না। হাসপাতালটা শহরের কেন্দ্রস্থলে ঠিক নয়। একপাশে বলা চলে। ছোট্ট শহরটায় রেললাইন আসার আগে হাসপাতালের দিকটায় তেমন জনবসতি ছিল না। হাসপাতালের পিছন দিকটায় রেলস্টেশন হওয়ার পর এদিকটায় প্রচুর বাড়ি তৈরি হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দোকানপাট। হাসপাতালের পাশ দিয়ে পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে। তার দুপাশে অগুনতি দোকান। কি পাওয়া যায় না সেখানে? তবে হোটেল, রেস্তোরাঁ আর ওষুধের দোকানের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বেশি। প্রথম দিন কাউকে কিছু না জানিয়ে হাসপাতাল থেকে দুপুরে বেরিয়ে এসে এরকমই একটা হোটেলে লাঞ্চ সেরে নিল সুমিত। খারাপ লাগে নি তার। বরং রান্নার স্বাদ বেশ ভালই লেগেছিল। ভেবেছিল কয়েকদিন কাছাকাছি কোন একটা হোটেলে থেকে যাবে। পরে একটা ভাড়ার ফ্ল্যাট দেখে নেবে।
{link}
হাসপাতালে এসে প্রথম পরিচয় হল রেজিষ্ট্রার ডা: অনিমেষ দত্তর সাথে। সুমিতের ঠিক উল্টো। সবসময় হৈ হৈ করতে ভালোবাসেন। ব্যাচেলার মানুষ। বছর পঞ্চাশ হবে! সুমিত দুপুরে হোটেলে খেয়ে এসেছে শুনে চিৎকার করে উঠলেন
--যাওয়ার কি দরকার ছিল? আমাকে বলবে তো? ওরা এখানে পাঠিয়ে দিত।
--আমার কিন্তু খারাপ লাগে নি।
--তোমার খারাপ লাগার কথা হচ্ছে না। ওরা জানে না তাই রক্ষে। তুমি ডাক্তার জানলে রোগীর লোকজনেরা ওখানে তোমাকে ছিঁড়ে খেত। তোমার খাওয়া আর হত না।
অনিমেষ দত্ত কিছুতেই সুমিতকে হোটেলে যেতে দিলেন না।
--তাই হয় নাকি ভায়া? একাকীত্ব কাটানোর সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন তো ছাড়তে পারব না। আমার ফ্ল্যাটে চল। নিজের ঘর হলে চলে যেও। কে বারণ করেছে!
সুমিত না বলতে পারেনি। অনিমেষদার ভালবাসায় আটকে গেছে। পরে জেনেছে নিশা যেখানে চাকরি করতে গেছে সেই ছোট্ট শহরটাতেই তাঁর বাড়ি। প্রকৃতপক্ষে নিশার কলেজটাও তার বাবার উদ্যোগেই তৈরি। অনিমেষদার বাবা মা যদিও কেউ এখন বেঁচে নেই তবুও ঐ কলেজের টানেই তিনি মাঝে মাঝে ঐ শহরে যান। সুমিত শুধু শুনে গেছে। নিশা সম্বন্ধে কিছু জানায় নি। মনে মনে হেসেছে। সেই নিশার সাথে সামান্য যোগসূত্র রয়েই গেল।
নিজের কাজে ডুবে গেল সুমিত। কিছুদিনের মধ্যেই আরামবাগের গৌড়হাটি মোড়ের কাছে একটা টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে এল। হাসপাতাল থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূরে গৌড়হাটি মোড়। বাস বা টোটোতে যাতায়াত করে। অনিমেষদার ফ্ল্যাটটা থেকেও এই ফ্ল্যাটটা বেশ কিছুটা দূরে। হাসপাতালের কাছাকাছি নিজের ফ্ল্যাটের কাছে সুমিতের জন্য একটা আস্তানা দেখেছিলেন অনিমেষদা। সুমিত রাজী হয়নি। নিশার সংযোগ থেকে একটু দূরই ভালো। আস্তে আস্তে নিজের ফ্ল্যাটটা সাজিয়ে নিয়েছিল। জিদ ধরে রান্না করার লোক রাখেনি প্রথমে। নিজে রান্নাবান্না তো শিখে নিয়েছে। অসুবিধে কি? পরে অবশ্য রাখতে বাধ্য হল। হাসপাতালে এত রোগী আসে! আশেপাশের গ্রামগুলোর প্রাণের ভরসা এই হাসপাতাল। গরীব অসহায় মানুষগুলোকে কখনও না বলতে পারে না সুমিত। অনর্গল কাজ করে যায়। হাসপাতাল থেকে যখন ফেরে তখন আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না। শরীর আর সায় দেয় না। ভোলা তার বাজার সরকার কাম রাঁধুনি হিসাবে নিযুক্ত হল। অনিমেষদাই দেখে দিলেন অবশ্য। মাঝে মধ্যে নিজে এসে সব কিছু তদারকিও করে যান তিনি। একদিন বললেন
--একজন মহিলাকে রান্নার কাজে রাখলে ভালো হত জানো সুমিত। ভোলা ঠিকঠাক রান্নাটা জানে না।
--রাখলেন না কেন?
--পাগল হয়েছ? একটা ব্যাচেলারের ঘরে মহিলা রাঁধুনি? আমি নিজের জন্য এই বয়সেও রাখতে সাহস পাইনা। তোমার তো ভলক্যানো এজ।
অনিমেষ দত্তর কথায় সুমিত হেসে ফেলে।
চলবে...
{ads}