সুমিতের কথা শুনে প্রথমে তা বুঝতে বোধহয় কিছুটা সময় লাগল নিশার। একটু পরে বোধগম্য হল। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুহাত কোমড়ে রেখে সেই পুরনো ভঙ্গীতে সুমিতের সামনে গিয়ে বলল
--মানে? তুই সব কিছু জানিস?
--হ্যাঁ। এই পর্যন্ত সবটাই জানা। শুধু এরপরে তোর মতিগতি কি হবে বলতে পারব না। আমি ভবিষ্যতদ্রষ্টা নই।
--কি করে জানলি?
--তোদের কলেজটা আমাদের হাসপাতালের রেজিষ্ট্রার অনিমেষ দত্তর বাবার তৈরি। উনি মাঝে মাঝেই যান ওখানে। তোদের ঐ মিটিঙেও উনি ছিলেন। ফিরে এসে সব আমাকে বলেছেন।
--তোর সাথে আমার রিলেশনের কথা উনি জানেন?
--না আমি কিছু বলিনি। তবে আমার ধারণা, আমার আগ্রহ দেখে উনি কিছু আন্দাজ করেছেন।
নিশা সোফার ওপর আবার বসে পড়ল। দুহাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার পরে বলল
--তুই এতটা কি করে পাল্টে গেলি রে? অনিমেষবাবু আমাকে খুব ভাল করে চেনেন। তোকেও চেনেন। অথচ তুই তাঁকে কিছু না বলে আমার সব কথা শুনে গেছিস তাঁর কাছ থেকে। আমার বিপদ জেনেও কোনদিন একটু খোঁজও নিলি না আমার? ফোন নম্বরটাও ডিলিট করে দিয়েছিলিস। আর আমি, বিপদে তোকে বন্ধু হিসাবে পাশে পাব বলে ছুটে এলাম? এরপরেও কি আমার এখানে থাকা উচিত?
--থাকা না থাকাটা তোর ইচ্ছে। কিন্তু যে জীবন তুই নিজে বেছে নিয়েছিলিস সেখানে যদি খারাপ কিছু হয়ে থাকে তাহলে তার দায় তো তোরই, তাই না? তুই তো নিজের ভাল হবে ভেবেই ঐ কলেজে গিয়েছিলিস আর মোহনবাবুকে বিয়ে করেছিলিস। তাহলে আমি কেন অনিমেষদাকে সব কিছু বলে হাসির খোরাক হতে যাব, বলতে পারিস? আজ বিপদে না পড়লে কি তুই আমাকে মনে রাখতিস? আসতিস এখানে? যতদিন আনন্দে ছিলিস ততদিন তো আমার কথা মনে পড়েনি তোর!
{link}
এই সুমিতকে সত্যিই নিশা চেনে না। সব কিছুতেই নিশার কথায় সায় দেওয়া সুমিত এটা নয়। সে যা যা বলল, কথাগুলো রূঢ় হলেও বাস্তব। একফোঁটা মিথ্যে নেই এতে। কিন্তু বিপদেই তো মানুষ বন্ধুকে খোঁজে। তাই সেও সুমিতকেই খুঁজেছিলো। নিশা আর কিছু বলে নি। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে সোজা দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল। তখনই তার পথ আটকে গম্ভীর গলায় সুমিত বলে উঠেছিল
---দাঁড়া। এভাবে আমার সব কথা না শুনে চলে গেলে হবে না। তোর সব কথা আমি শুনেছি। অনেকবার আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তুই তুলেছিস। আমি কোন প্রতিবাদ করিনি। তোর কথা চুপ করে শুনে গেছি। অপেক্ষা করেছি, ভেবেছি তুই ঠিক বুঝে নিবি আমাকে। কিন্তু তা যখন হল না, তখন আমার কথা তোকে শুনতেই হবে। বোস চুপ করে।
নিশা সোফাসেটটায় বসার পর সুমিত আবার বলতে শুরু করেছিল
---কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তুই একবারও ভেবেছিলিস আমি কিভাবে থাকব? মোহনবাবুকে বিয়ে করার সময় তোর একবারও মনে হয়েছিলো আমি সারাজীবন একা কি করব? আমি তোর ওপরেই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলাম। তুই ছাড়া আমার জগতে আর কে ছিল? আমার ভাল, মন্দ, ব্যথা, বেদনা সব নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পর হঠাৎ আমাকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়াটা কি ঠিক কাজ হয়েছিল? আমি হয়ত এখনকার মত সব কথা তখন মুখে আনতাম না। অনেক কিছুই বলতে পারতাম না। কিন্তু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। যেমন আমি বুঝে নিয়েছিলাম যে তুই আমাকে ভালবাসিস না। আমি শুধু তোর সঙ্গী, তোর হুকুম তামিল করা বা তোর ইগো স্যাটিসফাই করার উপকরণ মাত্র। এমনকি আমি তোর কাছে বন্ধুও ছিলাম না। প্রিয়জন নয়, প্রয়োজন ছিলাম। এই ধারণাটা যেদিন আমার কাছে ধরা পড়ল, সেদিন থেকেই আজকের সুমিত তৈরি হতে আরম্ভ করল।
নিশা অবাক হয়ে সুমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এত কথা সুমিত বলছে? বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
---মোহনবাবু তোর ওপর অত্যাচার করত বলে তুই তাকে মেনে নিতে পারলি না। ডিভোর্সে রাজি হলি। আর তুই এতদিন ধরে আমার ওপর যে অত্যাচার করলি? তার শাস্তি তুই নিবি না? তোকে ভাল না বেসে মোহনবাবু শুধু তোর শরীর চেয়েছিল বলে তুই তাকে তোর জীবন থেকে ছেঁটে দিতে চাইছিস। আর আমি যে তোকে সেই ছেলেবেলা থেকে ভালোবেসে আসার পর হঠাৎ তুই আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলি, তার বেলা? আজ আমার কাঠিন্য তোকে অবাক করতে পারে। কিন্তু এরকম হওয়া ছাড়া আর কি উপায় ছিল আমার? স্বাবলম্বী না হলে যে নেগলেকটেড হতে হয় তা তো জেনেই গেছি। এরপরেও কি নিজের জন্য ভাবাটা অন্যায়? কোন জবাব দিতে পারবি তুই?
{link}
অনিমেষ দত্ত প্রচন্ড টেনশনে রয়েছেন। এরকম আজ পর্যন্ত কোনদিন করেনি সুমিত। সাড়ে তিনটেয় তার ওয়ার্ডে রাউন্ডে যাওয়ার কথা। যায়নি। হাসপাতালে হই হই পড়ে গেছে। যে ডাক্তার সবসময় ডেডিকেটেড, সে হঠাৎ এরকম এবসেন্ট কেন হয়ে গেল তা চিন্তার বিষয় বই কি! অনিমেষ দত্তর কানে কথাটা এল প্রায় এক ঘন্টা পরে। তারপর থেকে অন্তত বার পাঁচেক ফোন করেছেন সুমিতকে। ও ফোন ধরে নি। হাসপাতালের কয়েকজন জানাল লাঞ্চে গিয়ে সুমিত আর আসে নি। কি এমন কারণ ঘটল যে সে ফোন ওঠাচ্ছে না। ওকে লাঞ্চের জন্য অনেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু তারপরের কথা কেউ জানে না। অনিমেষ দত্তও চিন্তায় রয়েছেন। একবার বরং সুমিতের বাড়িতে গিয়েই দেখা যাক। তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে গৌড়হাটি মোড়ের উদ্দেশে রওনা দিলেন।
দরজা খুলে অনিমেষদাকে দেখে সুমিত অবাক। তার অভিমান আর ভালবাসার কথা তখনই সবে সে প্রথমবার উচ্চারণ করেছে। নিশার করুণ আর অবাক মুখের দিকে তাকিয়েও সব কথা বলা থেকে নিরস্ত হয়নি। দুজনের কথাবার্তার মাঝে সময় কোন ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ডোর বেলের আওয়াজ শুনে প্রথম চমকটা ধরা পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সুমিত। এত বেলা হয়ে গেছে! অনিমেষদাকে দেখে বুঝতে পারে তিনি কেন এসেছেন। তবুও বলে
--কি ব্যাপার, আপনি?
বাইরে দাঁড়িয়েই অনিমেষ দত্ত বললেন
--ব্যাপার তো তুমি বলবে ভায়া। হাসপাতালে রাউন্ডে গেলে না। ফোন ওঠাচ্ছ না। অথচ সুস্থ শরীরে ঘরে বসে আছ। কি ব্যাপার বল তো?
--ফোনটা সাইলেন্ট করা আছে, তাই বুঝতে পারিনি। আপনি ভেতরে আসুন। সব জানতে পারবেন।
{ads}