প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের পর
সময় যত এগিয়েছে আস্তে আস্তে কলেজ ও তার পরিবেশের বর্ণনা থেকে সরে এসেছে নিশা। ক্রমশ আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে একটা মানুষের ওপর। সুমিত সব লক্ষ্য করেছে। বুঝতে পেরেছে। কিন্তু নিশাকে কিছু বলেনি। আবেগ আর উৎসাহ নিয়ে নিশা বলে গেছে
---আমাদের কলেজে একজন অধ্যাপক আছেন, মোহন সরকার, ইতিহাস পড়ান। কি দারুণ পড়ান। ওয়ান্ডারফুল!
---মোহনবাবু ইতিহাসের যে কোন বিষয় এত সুন্দর করে বোঝান মনে হয় সব বুঝি চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটছে। কথা বলেন খুব সুন্দর। অবাক হয়ে যেতে হয়।
সুমিতের সাথে সামনাসামনি অথবা ফোনে এসব কথা বলার সময় নিশা উত্তেজিত হয়ে পড়ত। সুমিত জানে, যে কোন পছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে বলতে গিয়ে নিশা চিরকালই এমন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মোহনবাবু যে নিশার পছন্দের মানুষ হয়ে উঠেছে তা সুমিত খুব বুঝতে পারছিল।
সেবার কলকাতায় এসে ময়দানে বসে নিশা মোহনের কথাই বলে যাচ্ছিল। হ্যাঁ, ততদিনে নিশার কাছে মোহনবাবু "মোহন" এ পরিণত হয়ে গেছে। কিছুই সুমিতের নজর এড়ায় নি।
---আমি মোহনের কাছে ইতিহাসের অনেক কিছু গল্পের মত করে শুনি। খুব ভালো লাগে জানিস। মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় যেন।
মোহনকে তোর কথা বলেছিলাম। তোর সবকিছু যে আমিই ঠিক করে দিই ওকে আগেই বলেছিলাম। কদিন আগে বলল তুই আমাকে বাদ দিয়ে নিজেকে সামলাচ্ছিস কি করে? ও তোর কথা খুব ভাবে জানিস। আমাকেও খুব কেয়ার করে। যত্ন নেয়।
সুমিত বুঝতে পারছিল কিভাবে ক্রমশ মোহনে আসক্ত হয়ে পড়ছিল নিশা। সব বুঝেও নিশাকে কিছু বলেনি, কোন প্রতিবাদ করেনি। নিশার কোন কিছুর প্রতিবাদ করা তার ধাতেই নেই! এতদিনের অভ্যাস বলে কথা, এত সহজে কি ছাড়া যায়?
নিশা কি নিজে বুঝতে পারছিল না যে সে ক্রমশ মোহনের দিকে এগিয়ে চলেছে? বুঝতে পারছিল। কিন্তু কিছুতেই সরে আসতে পারছিল না। বা সরে আসতে চাইছিল না। মোহন যেন তাকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। মোহনের কাছে থাকা, তার সাথে কথা বলা, তার কথা মত চলা সব কিছুতেই যেন এক অদ্ভূত আনন্দের স্বাদ পায় নিশা। ইদানীং নিশার কলকাতায় যাওয়াও কমে গেছে। যতবার সুমিতের সাথে ফোনে কথা হয়েছে বেশির ভাগ সময় নিশা মোহনের কথাই বলে গেছে। সুমিত সব বুঝতে পারে। নিশা ক্রমশ মোহনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হয়ত তার কিছু বলা উচিত ছিল। কিন্তু অভ্যাসবশত কিছুই বলে উঠতে পারেনি সে। ভেবেছে এসব নিশার সাময়িক মোহ! যেমন নিশা মাঝে মাঝেই কোন না কোন বিষয় নিয়ে করে। তাছাড়া, নিশা যদি সত্যিই মোহনকে ভালবাসে তাহলে সে কিই বা করতে পারে? শুধু নিজের যন্ত্রণা নিয়ে নিশার ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে সুমিত।
নিশা সুমিতের কাছে ফিরে আসে নি। কয়েক মাস পরে একদিন সকালে নিশার ফোন এল।
--তোকে একটা দারুণ সুখবর দেওয়ার আছে, জানিস? শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি।
সুমিত বুঝতে পারেনি কি সুখবর হতে পারে? নিশা কি কোন সরকারি কলেজে চাকরি পেয়ে গেল? নেট কোয়ালিফাই তো করেছিল! জিজ্ঞাসা করল
--কি খবর রে?
--মোহন আমাকে প্রোপোজ করেছে। আমরা আগামীকাল রেজিস্ট্রি করছি। মোহন ব্যবস্থা করে রেখেছে।
চমকে উঠেছিল সুমিত।
--মানে?
--মানে, আমরা বিয়ে করছি। আগামী কাল।
সুমিতের সামনে শুধু কুয়াশা। দৃষ্টি ঝাপসা। গলায় কোন আওয়াজ নেই। কোনরকমে বলেছিল
--এত তাড়াতাড়ি?
--মোহন একদম অপেক্ষা করতে চাইছে না রে।
--বাড়িতে বলেছিস?
--বাড়িতে বলার কি আছে? বিয়েটা তো আমি করব। তোকে আগে জানালাম। বাড়িতেও জানিয়ে দোব একসময়।
--বেশ, ভালো থাকিস।
সুমিত আর কিছু বলতে পারে নি। বলার মতো অবস্থাই ছিলো না তার।
বিয়ের পর নিশার ফোন বা কলকাতায় আসা আরও কমে যেতে লাগল। মাসে একবারও ফোন করে কিনা সন্দেহ! সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা বিয়ের মাসখানেক পর থেকে নিশার কলকাতায় আসা বন্ধই হয়ে গেল। তারপর ফোনও। দুটো বাড়ির মধ্যে সম্পর্কও অনেকটা শীতল। দুই কর্তার মধ্যে দেখা হলেও নিশার বাবা যেন সুমিতের বাবার সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারে না। এক দু কথা কোন রকমে বলেই চলে যেতে চায়। দু বন্ধুই বুকে পাথর নিয়ে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। নিশার মা চিরকালই চুপচাপ। সুমিতের মায়ের কাছে এসে সেও ক্ষোভ উগরে দিল একদিন
--আমার মেয়ে হতে পারে নিশা, কিন্তু সত্যি বলছি দিদি ও কাজটা ভাল করল না। সুমিত সব ব্যাপারে ওর কথা মেনে নিয়েছে এতদিন। ওর ভাল, মন্দ সব ও মেনে নিয়েছে। ওকে সেই ছোট্টবেলা থেকে চুপচাপ ভালবেসে গেছে। তার এই দাম দিল মেয়েটা? ছেলেটা যেন বোবা হয়ে গেছে। ওর কষ্ট দেখতে পারছি না।
সুমিতের মায়ের কি কষ্ট হচ্ছে না? ছেলেটা মুখচোরা। নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করে না। কিন্তু ও যে কি কষ্ট পাচ্ছে তা মা হয়ে বুঝতে কোন অসুবিধা নেই। আর তাই দিনরাত মরমে মরে যাচ্ছে। কি করে যে ছেলেটাকে স্বাভাবিক করা যাবে ভেবেই পাচ্ছে না। সুমিতের বাবার সাথেও কথা বলেছে। তিনি বলেছেন
--ওকে সময়ের হাতে ছেড়ে দাও। এই ধাক্কাটা হয়ত ওর স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য দরকার ছিল। শুধু একটু চোখে চোখে রাখতে হবে। যারা ইনট্রোভার্ট হয় তাদের নিয়েই যত মুশকিল। আর কিছুদিন যাক, ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি বরং ভাল মেয়ের খোঁজে থাক। আমিও দেখছি।
চলবে...