(প্রথম পর্বের পর)
রোজই এরকম কিছু না কিছু লেগে থাকত। নানা অজুহাতে নিশা সুমিতের সান্নিধ্যে আসতে চাইত। সুমিতের ব্যস্ততা বা সময়াভাবের কথা চিন্তাই করত না। সুমিতও কোনদিন সেভাবে চিন্তা করে নি। নিশা ডাকছে মানে যেতে হবে। এটাই বুঝে এসেছে এতদিন। মেনে নিয়েছে এটা। অনেক সময় ক্লাস কামাই করেও নিশার ডাকে সাড়া দিত সুমিত। সুমিতের বন্ধুরা নিশার এই ডাককে আড়ালে "নিশির ডাক" বলে উপহাস করত। সুমিত এই "নিশির ডাক" এর খপ্পর থেকে বেরুতে পারবে না, ছটফট করে মরবে বলে তারা উপহাস করত। কিন্তু সামনাসামনি কারোর কিছু বলার সাহস ছিল না। কারণ, সেই নিশা। জানতে পারলে তোড়ে উড়িয়ে দেবে সবাইকে। একজনও ওর সামনে একথা বলার সাহস পেত না। সুমিতের সামনে অবশ্য মাঝে মাঝে বলত। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার সময় নিশার ফোন এলেই তারা বলত "নিশির ডাক এসেছে"। আবার সুমিত যাতে নিশাকে জানিয়ে না দেয় তার জন্য অনুরোধও করত। মোদ্দা কথা নিশাকে ভয় করেই বন্ধুরা সুমিতকে সমীহ করত।
এইভাবেই সুমিতের সব কিছুর দায়িত্ব আস্তে আস্তে নিশা নিজের হাতে তুলে নিচ্ছিল। সুমিতও যেন নিশার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত। দু বাড়ি থেকে সব জেনেও চুপ করে থাকত। দু বাড়িরই প্রশ্রয় ছিল এই সম্পর্কে। থাকবে নাই বা কেন? দুটো পরিবারের মধ্যে হৃদ্যতা নতুন কিছু তো আর নয়! তা না হয় পরবর্তী ক্ষেত্রে আরও বাড়বে! সুমিতের বাবা মা বরং নিশার হাতে ভোলাভালা সুমিতকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। নিশা সুমিতদের বাড়িতে এলে সুমিতের মা তাকে মাঝে মাঝে বলতও
--গড়ে পিঠে নে ঠিক করে। পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই তো শিখল না সুমিত। তোর পাল্লায় পড়ে যদি বাস্তব জগত সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান হয়। নিজের ভালর জন্যই ওকে গড়েপিঠে নে।
নিশার চটজলদি উত্তর
--তুমি ভেব না তো আন্টি। আমি সব বুঝে নোব ঠিক। কারোর বাপের ক্ষমতা নেই সুমিতকে কিছু বলবে।
নিশার কথায় সুমিতের মা মুখ টিপে হাসত। শিক্ষিকা হয়ে অনেক ছেলেমেয়ে দেখেছে, কিন্তু এমন তেজি মেয়ে খুব কম দেখেছে। একটা আগ্নেয়গিরি যেন। সবসময় ফুটছে। তার ছেলের জন্য এমন মেয়েই উপযুক্ত।
নিশার বাবা মাও খুশী এই সম্পর্কে। ছেলে হিসাবে সুমিত যে ভাল এবিষয়ে তো কোন সন্দেহই নেই। সবচেয়ে বড় কথা নিশার খুব অনুগত। মেয়ে যা বলে সুমিত তাই শোনে। কোন বাবা মা মেয়ের জন্য এমন জামাই চাইবে না?
{link}
নিশার গ্র্যাজুয়েশন যখন শেষ হল তখন সুমিতের থার্ড ইয়ার শেষ হওয়ার মুখে। তারপরেও ওর আরও দেড় বছর পড়া, একবছর ইন্টার্নশিপ। মানে আড়াই বছর। ততদিনে নিশার মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার কথা। তাতে অবশ্য ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। যথারীতি ওদের জীবন একই খাতে বইছিল। নিশার ছত্রছায়ায় সুমিত এক ভাবেই এগিয়ে চলেছিল। ও নিশাকে ছাড়া জীবন যেন কল্পনাই করতে পারেনা। অভ্যাসটা এখন যেন তার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গোল বাধল নিশার মাস্টার্স কমপ্লিট হওয়ার পর। সুমিতের তখনও এম বি বি এস শেষ হয় নি। নিশা একটা ছোট মফস্বল শহরে প্রাইভেট কলেজে চাকরি পেল। সুমিতকে জানিয়ে বলল
--আমি ভাবছি কাজটা একসেপ্ট করব। হোক না প্রাইভেট কলেজ। জায়গাটা ভাল। তার চেয়েও বড় কথা কলেজটার ভাল রেপুটেশন আছে। তুই কি বলিস?
নিশা মতামত চাওয়াতে থতমত খেল
সুমিত। এরকম তো কোনদিন হয় নি। নিশাই চিরকাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাৎক্ষণিক কোন জবাব দিতে পারল না। নিশাই বলল আবার
--কি রে? বল কিছু?
কোনরকমে সুমিত শুধু বলল
--কি দরকার?
--দরকার আছে রে। আমাকে তো জানিস। কবে সরকারি কলেজে পাব ভেবে বসে পচা আমার ধাতে সইবে না। তার চেয়ে চলেই যাই।
সুমিত তখনও কিছু বলতে পারে নি। যেন সবকিছুই কাল্পনিক। নিশা তাকে ছেড়ে যেতেই পারে না।
নিশা কিন্তু চাকরিটা নিয়ে মফস্বলে চলে গেল। যাওয়ার আগে সুমিতের সাথে দেখা করতে গিয়ে বলেছিল
---সাবধানে থাকিস। নিজের খেয়াল রাখিস।
---কেন?
---কেন আবার কি? আমি তোর কাছাকাছি থাকব না। রোজ দেখাও হবেনা। কে তোর সবকিছু নজরে রাখবে? সবকিছু অডস থেকে বাঁচাবে কে শুনি?
সুমিত কোন কথা বলে নি। হাঁ করে নিশার দিকে তাকিয়ে ছিল। যেন এমন কিছু ঘটতেই পারে না। নিশা তাকে ছেড়ে চলে যাবে? ধূস্ এমন আবার হয় নাকি? সুমিতের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়েই সেদিন নিশা চলে গিয়েছিল। পরের দিন কলকাতা থেকে মফস্বল শহরটায় গিয়ে চাকরিতে জয়েন করেছিল নিশা। সুমিতের কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে এক বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছিল সেইদিন। অনেকদিন পর্যন্ত এটা বাস্তব বলে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিলো তার।
এরপরে যেটুকু কথা হয়েছে তা ফোনেই বেশি। মাঝে মাঝে ছুটির সময় নিশা কলকাতায় এলে দেখা হত। তাকে কাছে পেয়ে সুমিতের মনে আবেগের ঢেউ উঠলেও আগের মতই সে তা প্রকাশ করতে পারত না। ফোনেও নিশাই বেশি কথা বলত। সুমিত নিশ্চুপ শ্রোতা।
---এখানকার ছোট্ট শহরটায় এত সবুজ, এত সবুজ তুই কল্পনাই করতে পারবি না। কি ভালো লাগে! মনে হয় সবুজের কার্পেট পাতা কোন স্বপ্নের ওয়ার্ল্ডে গিয়ে পড়েছি। তুই দেখলে অবাক হয়ে যাবি।
---এখানকার লোকজন এত সৎ আর সরল যে কি বলব তোকে। কলকাতায় এমন মানসিকতা চিন্তাই করা যায় না। ছাত্র ছাত্রীদের গার্ডিয়ানরা কত ভেজিটেবলস যে দিয়ে যায়!
--জানিস, এখানকার সন্ধ্যে কত সুন্দর তুই না দেখলে বুঝতে পারবি না। আলো ঝলমলে হয়তো নয়, কিন্তু মাথার ওপর তারা জ্বলা আকাশের সামিয়ানা টা অসাধারণ। অ্যামেজিং।
চলবে...
{ads}