header banner

কলকাতার বিরিয়ানি ও তার ইতিহাস

article banner

তথাগত ঘোষ

নতুন চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হওয়া কিংবা জন্মদিনের ট্রিট দেওয়া এই শহরে বেশিরভাগ সময়েই এই খবর বন্ধুদের কাছে পৌঁছালে , সেদিক থেকে একটাই আবদার আসে, "ভাই খাওয়া” আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্ধুদের খাবারের উপকরন হিসাবে যা উঠে আসে তা হল সেই বিরিয়ানি। এই শহরের শহরবাসী নিজেদের ফ্রি টাইম বলতে সেই ভিক্টোরিয়া চত্বরে এক কাপ চা, একাডেমিতে নাটক, নন্দনে আড্ডা, রাতের পার্ক স্ট্রিট কিংবা উত্তর কলকাতার বাগবাজার ঘাটে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে আড্ডা এই সবেতেই অভ্যস্ত। আর এই সব কিছুর মাঝে মানিব্যাগে একটু টাকা আর সুযোগ হলেই আঠারো থেকে আশি সবাই ছুটে চলে যায় ছোট কিংবা বড়ো এক রেস্তোরায় বিরিয়ানির স্বাদ পেতে। এভাবেই সাধের বিরিয়ানি খাইয়ে শহরে যে কতো প্রেমিক তার প্রেমিকার মন জয় করে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এইরকমই কেউ যখন কাজের সূত্রে বা অন্য কোন কারনে শহরের বাইরে যায় তখন সেখানকার বিরিয়ানি খেয়ে সে অনুভব করে যে এই বিরিয়ানি আমি আগে শহরে যে বিরিয়ানি খেয়েছি তার থেকে আলাদা। দেশে এক একটি স্থানের বিরিয়ানি স্বাদে তো আলাদা বটেই তা সে হায়দ্রাবাদী হোক কিংবা পাঞ্জাবি মুর্গ বিরিয়ানি। কিন্তু অন্য সব যায়গার বিরিয়ানির সাথে কলকাতার বিরিয়ানির পার্থক্য গড়ে দেয় কিসে জানেন? মাংস কিংবা রন্ধন পদ্ধতি নয় পার্থক্য গড়ে দেয় বিরিয়ানির মধ্যে থাকা আলু, কারন কলকাতায় ছাড়া আর কোথাও বিরিয়ানির মধ্যে আলু দেওয়া হয়না। চমকপ্রদ না? এর পিছনেও এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
ইংরেজ আওয়াধ নগরি দখল করে নিলে ১৮৫৬ সালে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় আসেন। তখন তার তিনি ভেবেছিলেন তার নগরি আবার তার কাছে ফিরিয়ে দেবে ইংরেজরা। কিছুটা আশা থাকলেও ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ইংরেজরা সম্পূর্নভাবে বিদ্রোহ দমনেই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে এবং নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকেও আনুমানিক দু বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। জেল থেকে ছাড়ার পর তাকে দেশের যে কোন স্থানে থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তিনি তখন তার বসবাসের স্থান হিসাবে বেছে নেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজ-কে।  তিনি মেটিয়াবুরুজে বসবাস করা শুরু করার খবর পেতেই সমস্ত রাঁধুনি, সঙ্গীতশিল্পী সহ তার নগরীর সাধারন মানুষ আসতে শুরু করেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজে। 
সেখান থেকেই কলকাতায় ওয়াজিদ আলি শাহর রাঁধুনিদের হাত ধরে আগমন ঘটে আওয়াধি বিরিয়ানির। আওয়াধি বিরিয়ানি রান্না করা হয় “দম-ফুক্ত” স্টাইলে। এই স্টাইলে রন্ধনের সমস্ত উপকরন রন্ধন পাত্রে পুরে উপরের ঢাকনা পুরোপুরি ভাবে সিল করে দেওয়া হয় যাতে ভিতরের হাওয়া বাইরে না যেতে পারে। এই ভিতরের হাওয়া বাইরে না যেতে পারার ফলেই বিরিয়ানির মশলা, চাল, মাংস আর জাফরানের গন্ধ মিলেমিশে এক মন মাতানো গন্ধের আবির্ভাব হয়। এই দম-ফুক্ত স্টাইলেই আজও বিরিয়ানি রান্না হয় এই শহরের ছোট থেকে বড়ো সমস্ত রেস্তোরায়। এই বিরিয়ানি রান্না করতে গিয়েই কোন এক ওয়াজিদ আলি শাহ-র কোন এক রাঁধুনি তাতে আলু দিয়ে তা নবাবের সামনে পরিবেশন করেন। দম-ফুক্ত স্টাইলে রান্না হওয়ায় হাঁড়ির মধ্যে থাকা আরও সব উপকরন ও মশলা মিশে তা আলুতে এক অন্যরকম স্বাদ এনে দেয় ও তা তৎক্ষণাৎ নবাবের পছন্দ হয় এবং তিনি নির্দেশ দেন পরের বার থেকে যেন প্রতিবারেই বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া হয়। এভাবেই বিরিয়ানিতে আবির্ভাব ঘটে আলুর এবং তা ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। এছাড়াও অনেকে মনে করেন সেই সময় টাকার অভাবের কারনে ওয়াজিদ আলি শাহ বিরিয়ানির মাংসের খরচ বহন করতে না পারার কারনে তিনি মাংসের পরিবর্ত হিসাবে বিরিয়ানিতে আলু যোগ করেন। সে যেভাবেই হোক না কেন বিরিয়ানিতে আলুর আবির্ভাব কিন্তু সেই নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ এবং তার রাঁধুনিদের হাত ধরেই। তাই এরপর থেকে বিরিয়ানি খাওয়ার সময় কিন্তু তাদের ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না। 
সবশেষে একটাই কথা, শহরে যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন শহরে বিরিয়ানির প্রতি মানুষের প্রেমও বেঁচে থাকবে, তা সে আর্সালানের ৬৫০ টাকার প্লেটেই হোক কিংবা ফুটপাতের ধারে কোন সাধারন রেস্তোরার ১০০ টাকার প্লেটেই হোক। কারন শহরে মানুষ শুধু মানুষ নয়, খাবারেরও প্রেমেও পড়ে। 

{ads}

Food Eating Biriyani Taste Entertainment History Mughal Empire Nabab Wajid Ali Sah Kolkata West Bengal India

Last Updated :