header banner

উপলব্ধি:ইস্কুলের পাঠ- নিখিল কুমার চক্রবর্তী

article banner

উপলব্ধি 
(ইস্কুলের পাঠ)

আমাদের ছোটবেলায় "কিন্ডারগার্টেন", "মন্টেসরি" কিছুই ছিল না। কমপক্ষে পাঁচ বছর বয়স না হলে "ইস্কুল"এ যাওয়ার বালাই ছিল না। বাড়িতে তার আগে "সেলেট পেন্সিল" নিয়ে "মক্সো" করা চলত। বাবা মা পড়াশোনা নিয়ে পাঁচ বছর বয়সের আগে তেমন চাপ দিত না। "ইনফিন" "কেলাস" থেকে পড়া শুরু হত। ইনফিনের পর থেকে শুরু হত কেলাস ওয়ানের পড়া। কাউকে কাউকে ইনফিন থেকে একেবারে কেলাস টু তে ডবল প্রমোশন দেওয়া হত। কেলাস থিরির আগে বেঞ্চে বসার ব্যবস্থা ছিল না। মেঝেতে চট বা শতরঞ্জি বিছিয়ে বসতে হত। পড়া না পারলে হাতে, পিঠে, পাছায় মাস্টারমশায়ের ছড়ির দাগ বসত। তাও ইস্কুলে যাওয়ার আনন্দ ছিল অপার। বন্ধু বান্ধবদের সাথে হৈ হৈ করে দিন কাটানোর আনন্দ। মাষ্টারমশাইদের কাছে পাঠ নেওয়ার আনন্দ। টিফিনের সময় গাছ থেকে গাব, কদবেল, আম, জাম, সবেদা পেড়ে খাওয়ার আনন্দ। তা সে ফল কাঁচা পাকা যাই হোক না কেন! ইস্কুল মানে এখনকার মত "স্কুল" নয়। দু আড়াই বছর বয়স থেকেই নিজের ওজনের প্রায় সমান ওজনের ব্যাগ পিঠে নিয়ে কুঁজো হয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে ভোর হওয়ার আগেই "স্কুল" এ যাওয়া নয়। ছোট্ট খেলার মাঠে বসে "শাহরুখ, কাজল, শ্রদ্ধা, আয়ুষ্মান" বা "বাম, ডান, চরম, নরম" দের আলোচনা নয়। টিফিনবক্সের খাবার সবার আড়ালে বসে একা খাওয়া নয়। ইস্কুল মানে বড় খেলার মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি, নুনচিক, পিট্টু খেলার পরে হার জিত ভুলে একসাথে বসে গাছ থেকে পেড়ে আনা ফল বা বাড়ি থেকে আনা টিফিন ভাগ করে খাওয়া।

{link}
প্রশ্ন জাগতেই পারে, এসব কথা হঠাৎ বলতে বসলাম কেন? কারণ, চোখের সামনে আস্তে আস্তে শৈশব হারিয়ে যেতে দেখছি। ভবিষ্যতের চিন্তায় বা আরও পরিষ্কার করে বললে, অসুস্থ প্রতিযেগিতায় সামিল হয়ে যৌবনের কেরিয়ারের চিন্তায় শৈশব অবলুপ্ত হচ্ছে। তখন ইনফিন থেকে ডবল প্রমোশন দিয়ে তাদেরই কেলাস টু তে তোলা হত যারা তার যোগ্য। অর্থাৎ যারা সময়ের থেকে একটু এগিয়ে। সবাইকে এমন প্রমোশন দিলে তার কুফল কি তা সহজেই অনুমেয়। তখনকার মাস্টারমশাইরা তা বুঝতেন। আর বুঝতেন বলেই মুড়ি মুড়কির একদর করতেন না। এখনকার মাষ্টারমশাইরা বোঝেন না তা নয়। তবে তাঁরা এটাও বোঝেন যে এখন মিডিয়া আছে, মানবাধিকার বোধ আছে, বাবা মায়ের উচ্চাকাঙ্খা আছে আর সর্বোপরি রাজনীতি আছে। তাঁরাও পরিস্থিতির শিকার। সুতরাং, শৈশব ডিঙিয়ে সোজা কৈশোরে বা যৌবনে ঢুকলে তার ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বুঝিয়ে বলার দরকার নেই, সবাই চাক্ষুষ করছি। এখন তো আরও বড় সমস্যা দোরগোড়ায় হাজির। অতিমারীতে স্কুল বন্ধ। শিশুদের শৈশব আরও বিপন্ন। নামী দামী স্কুলগুলো অনলাইনে পড়াশোনা করাচ্ছে। বাবা মা বাধ্য হয়ে শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। আর মোবাইল মানে তো শুধু অনলাইন পড়াশোনা নয়, অন্তর্জালের জগতের হাজার প্রলোভনের হাতছানি। শিশু মনে কৌতূহল এমনিতেই বেশি থাকে। সেই কৌতূহল তাকে মোবাইলকে অন্যভাবে ব্যবহার করতে শেখাতেই পারে। বাবা মাকে হাজার ব্যস্ততার মাঝে তাই এ বিষয়ে নজর রাখতেই হয়। আমার ঠাকুমা এক্কেবারে গ্রাম্য মহিলা ছিলেন। তিনি একটা গল্প বলতেন। গ্রামের এক গরীব মহিলা একটা জামবাটি (পিতলের তৈরি ভারী বড় বাটি) নিয়ে গ্রামের মুদির দোকানে হাফ কেজি গুড় কিনতে গেছে। মুদি পাল্লার একদিকে পাঁচশ গ্রামের বাটখারা রেখেছে। অন্যদিকে ঐ বাটিতে কিছু গুড়। বাটখারার দিকে বাটির সম ওজনের "করতা" রাখতে ভুলে গেছে। ফলে, বাটি বেশি ভারী হওয়ার দরুন ঐ দিকের পাল্লা মাটিতে থেবড়ে বসেই আছে। দুদিকের পাল্লা সমান করার জন্য মুদি বাটি থেকে গুড় তুলেই যাচ্ছে। একসময় সবটুকু গুড় তুলে নেওয়ার পরও বাটি সমেত পাল্লা ওঠে না। মহিলাটি অবাক হয়ে মুদিকে জিজ্ঞাসা করে,"সব গুড় তো তুলে লিলে গো!" মুদি সহাস্যে বলে, "তোর বাটি থাকে না কি দেখ!" তখন গল্পের সারমর্ম বুঝতাম না। আজ মনে হয়, মূল্যবোধের এই অবক্ষয়ের দিনে, ইস্কুলের শৈশব হারানোর দিনে শিশুদের কেরিয়ার তৈরির দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে আমরা "করতা" দিতে ভুলে যাচ্ছিনা তো!

{ads}

news feature short story story bengali story essay realization literature school life গল্প ছোট গল্প প্রবন্ধ সংবাদ

Last Updated :