header banner

হাওড়ার পাল বাড়িতে আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছর ধরে অভয়া রূপে পূজিতা হন দেবী দুর্গা

article banner

নীল আকাশে খেলা করছে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, মায়ের আসতে বাকি আর মাত্র কয়েকটা দিন। এতোদিন পর্যন্ত বাংলার মাটি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটি বনোদি ও রাজবাড়ির সমস্ত অবাক করা পুজো ও তার পদ্ধতির কথা আমরা পড়েছি। এহেন কয়েকটি পুজো বহু বছর ধরে হয়ে চলেছে  হাওড়া জেলার বুকেও। গঙ্গাপারের পরিচিত এই জেলায় প্রাচীন যে সমস্ত বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোগুলো এখনও পর্যন্ত সেই প্রাচীন প্রথা মেনে ঐতিহ্যের সাথে চলে আসছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো শিবপুরের পাল বাড়ির দুর্গাপুজো। 


স্থানীয় মানুষদের মতে দেশে ব্রিটিশ শাসনেরও আগে থেকে শুরু হয় এই পুজোর। তবে নির্দিষ্টভাবে ঠিক কত বছরের পুরনো তা বলা সম্ভব না হলেও আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে পাল বাড়ির বংশধরদের হাত ধরে চলে আসছে এই পুজো । বাড়ির তিন খিলানের প্রাচীন অপ্রশস্ত ঠাকুরদালানটিই বহন করছে তার প্রমাণ।


প্রতিটি বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও পালবাড়ির দুর্গাপুজো অন্যান্য বনেদি বাড়িগুলির থেকে অনেকটাই আলাদা। অধিকাংশ বাড়িতেই দেবী দশ হাতের মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা হলেও এই বাড়িতে দেবী পূজিতা হন অভয়া রূপে। এই বাড়ির দুর্গা প্রতিমায় দেবী দুর্গার মূর্তিতে দুটি হাত থাকে । হাত দুটিতে কোনো অস্ত্র থাকে না । মায়ের একটি হাতে থাকে অভয়া মুদ্রা , যার মাধ্যমে তিনি যেন সকল মনুষ্যকুলকে আশীর্বাদ করছেন । অন্য হাতে থাকে একটি ফল ও প্রস্ফুটিত পদ্ম । দেবী দুর্গা এখানে সিংহবাহিনী হলেও প্রতিমার সাথে কোনো মহিষাসুর থাকে না । একচালা দুর্গা  প্রতিমার দু পাশে থাকে সরস্বতী , লক্ষী , কার্তিক ও গণেশ ।

{link}

কিভাবে এই পুজো শুরু হয় তার সঠিক কোন ইতিহাস জানা না গেলেও , মনে করা হয় পালবাড়ির আদিপুরুষ সর্ব্বোস্ব পাল একদিন হঠাৎ করেই একদিন স্বপ্নাদেশ পান এই পুজো শুরু করার।  তারপর থেকেই শুরু হয় এই পুজো । তবে এই বাড়ির দুর্গাপুজো সবচেয়ে বেশি খ্যাতিমান ও জৌলুস অর্জন করে ওই বংশেরই সন্তান এককালের ভারত বিখ্যাত ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা বটকৃষ্ণ পালের আমলে । তিনি শিবপুরের এই পাল বাড়িতেই ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । তারপর কলকাতায় গিয়ে ওষুধের ব্যবসা শুরু করে জগৎবিখ্যাত হন । তার প্রতিষ্ঠিত বটকৃষ্ণ পাল এন্ড কোম্পানির ওষুধের সুপরিচিতি সেই সময় বিলেতের মাটিতেও ছিলো । পরে তার নামেই কলকাতার শোভাবাজারে বি কে পাল এভিনিউ এর নামকরণ হয় । হাওড়ার শিবপুরের বি . কে . পাল স্কুলও তারই নামেই প্রতিষ্ঠিত হয় ।

{link}

পাল বাড়িতে দেবী দুর্গার অভয়া মূর্তি হলেও সেখানে পুজো হয় শাক্ত মতে । শোনা যায় পালবাড়ির এই দুর্গা ও শিবপুরের রায় চৌধুরী বাড়ির দুর্গাকে দুই বোন রূপে কল্পনা করা হয় । রথযাত্রার দিন পালবাড়ির ঠাকুর দালানে বহু শতাব্দী প্রাচীন দেবী দুর্গার কাঠামোটিকে পুজোর মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় মূর্তি গড়ার কাজ । ডাকের সাজে ধীরে ধীরে সুশোভিত হতে থাকে মায়ের মূর্তিটি । চিরাচরিত প্রথামত দূর্গাপুজোর নবমী তিথির ঠিক ১৫ দিন আগে কৃষ্ণনবমী তিথিতে বোধনের মাধ্যমে শুভ সূচনা হয় পাল বাড়ির দুর্গাপুজোর । উৎসবের আবহে সেজে উঠতে থাকে বহু শতকের এই প্রাচীন বনেদি বাড়ি ।

 

 দেবীর আরাধনার পাশাপাশি এরপর থেকে নবমী পর্যন্ত টানা ১৫ দিন ধরে চলে চণ্ডীপাঠ। পাল বাড়ির পুজোর এরকমই আরও নানান বৈচিত্র্য রয়েছে । এখনকার পুজোয় মাকে অন্নভোগ দেওয়ার প্রথা নেই । বদলে লুচি , মিষ্টি , ফলের মাধ্যমেই দেবী দুর্গাকে ভোগ দেওয়া হয় । সপ্তমীর দিন সকালে গঙ্গার পরিবর্তে বাড়ির ঠাকুরদালানেই নবঘটের জলের মাধ্যমে স্নান করানো হয় কলা বউকে । মায়ের আরাধনায় পুজোর তিন দিন বলিদানও হয় । সপ্তমীতে পাঠাবলি , অষ্টমীতে ফল বলি ও নবমীতে মোষ বলি হয় পাল বাড়িতে । যদিও বলিদানের কোনো প্রসাদই পরিবারের সদস্যরা গ্রহণ করেন না । তা প্রসাদ হিসেবে প্রদান করা হয় পুজোয় উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে । এখানকার সন্ধিপুজোয় বাড়ির মেয়েরা শামিল হতে পারেন না । সন্ধিপুজোর সমস্ত কাজই বাড়ির ছেলেরা মিলে সম্পন্ন করেন । শোনা যায় , বহু বছর আগে সন্ধিপুজোর ঠিক প্রাক মুহুর্তে হাওড়ার বিখ্যাত আন্দুল রাজবাড়ি কামান দাগা হতো । সেই কামানের শব্দ শোনার পরই সন্ধিপুজোর শুভারম্ভ হতো পাল বাড়িতে । যদিও এখনও রীতি মেনেই সন্ধিপুজো শেষ হয় হোম যজ্ঞের মাধ্যমে । 


এহেন নিয়ম মেনেই বহু বছর ধরে চলে আসছে হাওড়ার পালবাড়ির এই বিখ্যাত পুজো। স্থানীয় মানুষদের কাছে এই পুজোর মাহাত্ম বিপুল। প্রতি বছর মায়ের আশির্বাদের আশায় বহু মানুষ এসে ভিড় করেন এই পাল বাড়িতে। সাধারন মানুষের কোলাহলে পুজোর দিনগুলি মুখরিত হয়ে ওঠে পাল বাড়ির প্রাঙ্গন। 
{ads}

news Durga Puja puja historical puja Rajbarir Pujo Jomdidar Barir Pujo Kolkata Howrah Tradition culture history West Bengal India দুর্গাপুজো জমিদার বাড়ির পুজো রাজবাড়ির পুজো

Last Updated :